দ্রব্য মূল্যের বৃদ্ধিতে কষ্টে আছে মানুষ- -আলী আকবর মাসুম

সম্ভাবনার বাংলাদেশ বা সংকটে আবর্তিত দেশ- পৃথক ভাবে এই দুটি কথার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন । তবে দুই দিক থেকেই প্রায় সমান ভাবে এ অবস্থা দেখা যায় বলে দেশের পরিস্থিতিতে বলা যায়, বাংলাদেশ এখন মধ্যবর্তী এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ সংকটের এক একটি চাপে আশা-ভরসার কিছু খুঁজে না পেয়ে কখনো কখনো হতাশা ও কষ্টের সাগরে ভাসেন। আবার এমন অনেকে আছেন দেশের সম্ভাবনার বৃত্তকে ঘিরে জীবনে স্বপ্ন দেখেন বা আশা নিয়ে বাঁচেন বলে সামনের দিকে এগিয়ে চলেন সব শক্তি নিয়ে । স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে বার বার সংকটে পড়েছে দেশ ও দেশের মানুষ । তারপর তা থেকে উত্তরণ যেখানে যেটুকু ঘটেছে, সেখান থেকেই আবার সংকট বা সমস্যার নতুন কোনো মাত্রাও যোগ হয়েছে । রাজনীতিক অস্থিরতা ও অচলাবস্থার মতো পরিস্থিতি ছাড়াও চলমান এই বছরটিও শেষ হচ্ছে- গ্যাস, বিদ্যুৎ, ডলার সংকটের সঙ্গে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উর্ধ্ব মূল্যের অসহনীয় অবস্থা, জনজীবনে ভোগান্তি ও ভবিষ্যতের অজানা আতংক নিয়ে । চাল, ডাল, আটা, তেলের মতো অতি জরুরি সব খাদ্য পণ্যের প্রায় দ্বিগুন দাম বৃদ্ধিতে একভাবে না একভাবে পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে গত কয়েক বছর অনেক বেশি কষ্টে আছেন দেশের মানুষ । নকল পণ্য ও ভেজাল খাদ্যের বেপরোয়া কারবারে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বেড়েছে অনেক । বাংলাদেশ এখনো কৃষি প্রধান একটি দেশ হিসেবে বিবেচিত । দেশে খাদ্য শষ্য ও কৃষি পণ্যের যতকিছু উৎপন্ন হয় তার অনেক কিছুই দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে বলা যায় যথেষ্ট । কিন্তÍ যখন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর কৃষক তাঁর পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান না, মজুদদার ও মধ্যস্বত্ব ভোগিরা তাদের ইচ্ছা মতো পণ্যের বাজার দর নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রন করেন তখন দুর্ভোগ আর কারসাজির নিয়মে পরিনত হয় দেশের বাজার ব্যবস্থা । এদিক থেকে অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত বাজার পরিস্থিতিতে নিত্যদিনের খাদ্য বা পণ্য কিনতে গিয়ে দেশের নাগরিক বা যে কোনো ভোক্তা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, প্রতারণার শিকার ও অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন পদে পদে ।

 

inside post

সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সরকারের দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কার্যকর এবং ফলপ্রসূ শাসন, প্রশাসন থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে এ পর্যন্ত মানুষ তার সুফল খুব বেশি পায়নি । এ প্রসঙ্গে তার উদাহরণ হিসেবে বলাই যায়, দেশের অর্থনীতিক ব্যবস্থার ধারায় বাজার ব্যবস্থা ও ব্যাকিং ক্ষেত্রে যেরকম আধিপত্য মূলক অবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সরকারের একরকম অসহায়ত্বও বার বার প্রমাণিত হয়েছে । ১৯৯১ সালের পর থেকে যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিলেন তার বাজার ব্যবস্থায় সুষ্টু ব্যবস্থাপনা ও সঠিক মাত্রার কোনো নিয়ন্ত্রন ছিল বলে বলার সুযোগ নেই । বরং নিয়মের ফাঁকে একশ্রেণির ব্যবসায়ী অনিয়ম ও অতি মুনাফার সুযোগ যেমন নিয়েছে, আবার অবৈধ ও অন্যায় ভাবেও ব্যবসার প্রসার এবং আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়েছেন তার সংখ্যাও কম নয় । বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের মধ্যে বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপী বাড়ায় তারল্য সংকট ও সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক ঋণের সুবিধা পাচ্ছেন না । এক্ষেত্রে ন্যায়-নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন । তার পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে মানুষের চাহিদা ও সামর্থ্যরে মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তন এবং উন্নতি ঘটেছে । তবে চাহিদা ও সামর্থ্যরে বিবেচনা সত্ত্বেও সবসময় সর্বত্রই দেখা গেছে, বাজার ব্যবস্থায় সরকারের নীতিগত অবস্থান এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ কখনোই জীবনধারণ ও জীবনযাপনে স্বস্তিতে ছিলেন না । এনিয়ে প্রতিটি সরকারের সময়ে বিরোধী রাজনীতিক পক্ষ ও জনগনের দিক থেকে কম-বেশি প্রতিবাদ, বিক্ষোভ যেমন হয়েছে, তেমনি এখনও তাই হচ্ছে । তারপরও তাতে কখন কতটা জনগণের উপায় বা উপকার হয়েছে তা নিশ্চয়ই পত্রিকার পাতা বা সরকারি তথ্যের বাইরে সময়ের স্বাক্ষী কোনো মানুষও কম জানেন না । যদি ধরে নিই, কুঁড়ি বছর আগে কারো মাসিক আয় দশ হাজার এবং এরই মধ্যে তা দ্বিগুন হয়ে বিশ হাজার টাকা হয়েছে, তাসত্ত্বেও কী বলা যায়- এ পরিমান টাকায় ৩-৪ জনের সংসারে খাওয়া,পরার সঙ্গে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা বা একজনেরও পড়ার খরচ মেটানো যায় । আর যদি তা না-ই সম্ভব হয় তখন সব বাদ দিয়ে কেবল ডাল ভাতের অপুষ্টির শরীর আর রোগ-ব্যাধি নিয়েই চলতে হয় এক একটি পরিবারকে , অথবা সুযোগ থাকলে প্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত অর্থ আয়ের জন্য অন্যায়, অবৈধ পন্থার আশ্রয় নেন কেউ কেউ । মধ্যবিত্ত ও নি¤œ বিত্তের অধিকাংশ মানুষ সাধারণ কোনো চাকুরে বা ছোট ব্যবসায়ী অথবা দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষ । তাঁদের মধ্যে কারো কারো পরিবারে একমাত্র উর্পাজনকারী হওয়া সত্ত্বেও আছেন- বয়স্ক, অসুস্থ বা অক্ষম কিংবা কর্মহীন ও সম্পূর্ণ বেকার । এসব মানুষ ও তাঁদের পরিবার গুলো যখন অন্য সময়েও অভাব,অনটন এবং অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করেন, তারপর আবার যখন দ্রব্যমূল্য বা খাদ্য পণ্যের দাম পঞ্চাশ থেকে শতভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় তখন তাঁদের পরিবারে কী পরিমান দুর্গতি নেমে আসে তার কতটাইবা কে অনুভব করতে পারেন । এক্ষেত্রে সরকারের যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে সেগুলোর সহায়তার কথা আসতেই পারে। কিন্তু মাত্র কদিন আগে ঢাকায় অনুষ্টিত এক ওয়েবিনারে উত্থাপিত তথ্যে দেখা যায়, কেবল দরিদ্রদের জন্য যে সামান্য সুবিধা রয়েছে তার একাত্তর ভাগ, ভুল মানুষ- এসব সুবিধা পাচ্ছেন । অর্থাৎ সবাই তো পাচ্ছেনই না, আবার যাদের পাবার কথা তাদের বাইরে অধিকাংশদের দেওয়া হচ্ছে খেয়াল খুশি মতো কেবল পছন্দের লোকদের । খোলা বাজারে কয়েকটি স্থানে টিসিবি’র পণ্য বিক্রির চিত্র কিছুদিন যাবত দেখা গেলেও অল্পসংখ্যক মানুষ হয়তো তার কিছু পাচ্ছেন। কিন্তু লোকলজ্জায় লাইনে দাঁড়ান না বা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়েও যখন খালি হাতে দরিদ্র নারী-পুরুষ কেউ মলিন মুখ ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে যান, তখন প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত মানুষের এমন অসহায়ত্বের চিত্রটি দেশের জন্যও অসম্মানের হয়ে উঠে ।

 

বিশ্বব্যাপী আর্থিক অবস্থার সংকট বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে, একথা অস্বীকারের সুযোগ নেই । যে কারণে ডলার সংকটে খাদ্য পণ্য আমদানি কমেছে, প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানিও কমেছে । এ প্রেক্ষিতে সরকারের দিক থেকে ব্যয় সংকোচন বা সাশ্রয়ী হওয়ার কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেও তার কার্যকারিতা ও সুফল খুব একটা নেই। বিদ্যুৎ, গ্যাসের চাহিদা ও নির্ভরতা পর্যায়ক্রমে অনেক বৃদ্ধি পেলেও এক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অপচয় ও চুরি রোধসহ তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যবহার বাদ দেওয়া হয়নি । প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস ব্যবহারে ছোট-বড় সব রকম যানবাহন গ্যাস চালনায় রুপান্তর এবং গ্যাসের ভবিষ্যত মজুদ বিবেচনা না করে যত বেশি শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ ও উৎপাদনে নির্ভরশীল করা হয়েছে তার যৌক্তিকতা নিয়ে শুরুতেও প্রশ্ন ছিল, আজও আছে । তারসঙ্গে অন্যান্য প্রায় প্রতিটি খাতেও যেরকম অতিরিক্ত ব্যয়, অপচয়, অপব্যবহার, চুরি, দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ নিয়মিত প্রকাশ পায় তার প্রেক্ষিতে মোটেও বলার সুযোগ নেই যে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারনেই অব্যাহত মূল্যস্ফীতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সহ ডলার ও অর্থ সংকট দেশে এতটা প্রকট হয়েছে । বরং বলা যায়, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, মজুদদার, চোরাকারবারী, অর্থ পাচারকারীদের দৌরাত্ম ও ধনীক শ্রেণি কেন্দ্রীক ব্যাকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সরকারের ব্যবসা বান্ধব উদারতা ও ‘ব্যবসা বান্ধব বাজেট’ নীতির সুযোগে দেশের অর্থনীতিক এবং বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রনহীন ও অব্যবস্থাপনার নৈরাজ্যের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। শুধু বাজার তদারকি যে খুব ফলপ্রসু কিছু নয়, তা অনেকটা স্বীকার করেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে প্রচলিত আইনের সংশোধন ও আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিতের কথা বলেছেন । একদিকে দেশের ভোক্তভোগি জনগণ, অন্যদিকে সাধু-অসাধু ব্যবসায়ীদের নিজস্ব অবস্থান । তার মাঝে সরকারের মধ্যবর্তী পন্থার অনুসরণে দেশ ও মানুষের সংকটের যথার্থ সমাধান কতটা সম্ভব তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। দেশে এরকম পরিস্থিতি চলতেই থাকলে দ্রব্যমূল্যের উঠানামা সহ বাজার ব্যবস্থায় সরকারের যেমন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, তেমনি দেশ ও সমাজ জীবনে শান্তি, স্থিতিশীল অবস্থার পরিবর্তে আরো ভারসাম্যহীন এবং চরম বৈষম্য মূলক নিপীড়নের শিকার হবেন দেশের বেশিরভাগ মানুষ ।

 

লেখক: মানবাধিকার বিষয়ক পরামর্শক, কুমিল্লা।

 

 

আরো পড়ুন