ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পানির জন্য হাহাকার!

inside post
নলকূপ- সাধারণ পাম্পেও পানি ওঠছে না
 ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ ভোগান্তিতে
এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ।।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামা, পুকুর-ডোবা-খোলা জায়গা ভরাট, পুকুর-খাল-নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়া এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাত্রাতিরিক্ত সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপনের ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় দেখা দিয়েছে সুপেয় ও গৃহস্থালির কাজে পানির তীব্র সঙ্কট। কোথাও কোথাও পানির জন্য মানুষ একরকম হা-পিত্যেশ দশায়। নলকূপ ও সাধারণ পাম্পে পানি না ওঠায় জেলার ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চরম ভোগান্তিতে দিনাতিপাত করছেন। তারউপর গরমের তীব্রতায় অবস্থা আরো কাহিল।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, পানির স্তর ৪০ থেকে ৬০ ফুটের নিচে নেমে যাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার বাসা বাড়িতে নলকূপ ও সাধারণ মোটর দিয়ে পানি তোলা হয়ে ওঠেছে অসম্ভব। সদরসহ জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও পানির স্তর ৩০ থেকে ৬০ ফুটের নিচে নেমে গেছে। এতে জেলার অন্তত ৩৩ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলার ৯ টি উপজেলায় সরকারি হিসেবমতে ৫৪ হাজার ৬৫১টি হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে গত দুই যুগে ১২ হাজার ২০৮টি নলকুপ বন্ধ হয়ে গেছে। অগভীর নলকূপ রয়েছে ১৯ হাজার ৬০০টি। তন্মধ্যে বন্ধ রয়েছে ৯ হাজার ৯১০টি। অগভীর নলকূপের গভীরতা ৬০ থেকে ৭৫ মিটার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার পানি শাখা সূত্র জানায়, পৌরসভায় পানির গ্রাহকের সংখ্যা তিন হাজার ৪০০টি। তাঁদের জন্য পানি দরকার হয় তিন লাখ ৪০০ হাজার লিটার। পানি উত্তোলনের মোট ৯টি নলকূপের মধ্যে সচল আছে পাঁচটি, অপর চারটি বন্ধ। পৌর শহরের ভাদুঘর, পশ্চিমমেড্ডাস্থ সদর উপজেলা পরিষদ (সিও অফিস) প্রাঙ্গন, পূর্বমেড্ডার তিতাসপাড়া এবং পাইকপাড়ায় পানি শাখার পানি উৎপাদনের নলকূপ বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে দুই লাখ ৬০ হাজার লিটার পানি গভীর নলকূপ ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে উত্তোলন করা হয়। বর্তমানে পৌর এলাকার অধিকাংশ নলকূপ ও সাধারণ মোটর দিয়ে পানি ওঠছে না। গত এক যুগে সরকারি উদ্যোগে স্থাপন করা ৬০টি নলকূপের মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র দশটি। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় এলাকাভেদে পানির স্থিতিতল সর্বনিম্ন ৩৫.৩৬ ফুট (১০.৭৮ মিটার) থেকে সর্বোচ্চ ৪৪.৯৮ ফুট (১৩.৭১ মিটার)। তবে সদর উপজেলায় সরকারিভাবে ১৫০ মিটার বা ৪৯২ ফুট গভীরতায় নিচে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। আর ব্যক্তি উদ্যোগে অগভীর নলকূপ স্থাপনে ১৮০ থেকে ২৫০ ফুট গভীরে যেতে হয়। সদরে সরকারি দুই হাজার ৪৭৩টি গভীর নলকূপ চালু রয়েছে। এছাড়া বন্ধ রয়েছে এক হাজার ৪৮৬টি নলকূপ।
জেলা তথ্য বাতায়নের তথ্যে জানা গেছে, পুরো জেলায় পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৭টি খানা রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় প্রায় দুই লাখ ৬৪ হাজার ৩৪১ এবং সদর উপজেলায় পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৯৯৪ মানুষের বসবাস। পৌরসভাসহ উপজেলায় প্রায় ৭০-৮০ হাজার নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ নলকূপেই ওঠছে না পানি। জেলা শহরের কান্দিপাড়া, কাজীপাড়া,শিমরাইলকান্দি, হালদারপাড়া, মধ্যপাড়া, ফুলবাড়িয়া, পাইকপাড়া, মেড্ডাসহ পৌরসভার বেশির ভাগ এলাকায় প্রায় এক মাস ধরেই নলকুপে পানি ওঠা বন্ধপ্রায়। এসব এলাকার বাসাবাড়ির সাধারণ মোটর দিয়েও পানি ওঠে না। সুপেয় পানির জন্য মানুষ প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ফলে বিশাল জনগোষ্ঠী সুপেয় ও গৃহস্থালির কাজে পানির তীব্র সঙ্কটে ভুগছেন। কোথাও কোথাও পানির জন্য মানুষের মাঝে একরকম হা-পিত্যেশ দশা বিদ্যমান। এদিকে জেলার বিজয়নগর, আখাউড়া ও কসবা উপজেলার অপেক্ষাকৃত উচুঁভূমি তথা পাহাড়ি এলাকায় পানির সঙ্কট আরো তীব্রতর। কোথাও কোথাও জনজীবন প্রায় অচলাবস্থায় নিপতিত। বৃষ্টিহীনতায় পরিস্থিতি ক্রমশই নাজুক হয়ে ওঠছে।
জেলা শহরের পশ্চিমমেড্ডা মহল্লার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘পানির সঙ্কটের কথা বলে বুঝানোর মতো নয়। আমাদের পীরবাড়ি বাসস্ট্যাণ্ড লাগোয়া মসজিদের অযুখানায় পানি তোলা সম্ভব হচ্ছে না অন্তত ১৫ দিন ধরে। আজানের সাথে সাথে মুয়াজ্জিন প্রত্যেক মুসল্লিকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে অযু করে মসজিদে আসার জন্য অনুরোধ জানাতে বাধ্য হচ্ছেন। এতেই প্রতীয়মান হয়- পানির দুর্ভোগ কতোটা চরমে পৌঁছেছে।’ কাজীপাড়া মহল্লার আলী মিয়া বলেন, ‘বাড়ির নলকূপসহ মোটর দিয়েও পানি ওঠেনা। দোকান থেকে পানি কিনে মেপে মেপে ব্যবহার করতে হচ্ছে।’ শিমরাইলকান্দির আকরাম হোসেন বলেন, ‘বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। খাল শুকিয়ে রয়েছে। সাধারণ মোটরে পানি ওঠছে না। প্রতিদিন আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে পানি আনতে হচ্ছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী সুমন দত্ত বলেন, ‘পৌরসভায় পানির স্তর ৪০-৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। গত এক যুগ আগে ১২০-১৬০ ফুট গভীরে হস্তচালিত নলকূপ দিয়ে পানি আসতো, অথচ এখন ১৮০ ফুট নিচ থেকেও আসছে না; ২০০-২২০ ফুট গভীরে যেতে হয়। আগে ২৯০-৩০০ ফুট নিচ থেকে অগভীর নলকূপে পানি পাওয়া যেতো, কিন্তু এখন ৪২০-৪৫০ ফুট নিচে যেতে হয়।’ তিনি বলেন, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাত্রাতিরিক্ত সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন, পুকুর ও খোলা জায়গা ভরাট, পুকুর, খাল ও নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ।’ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সদর উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী সামিরা আক্তার বলেন, ‘পানির স্তর নিচে নেমেছে। অনেকেই পানির সমস্যায় ভুগছেন।’ এদিকে জেলার সরাইল উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. রূপক মিয়া বলেন, ‘সরাইলে পানির স্তর ৩৭ ফুট নিচে নেমেছে। বর্তমানে ৫৫০ ফুট নিচে গভীর ও ১৮০-২০০ ফুট নিচে অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। উপজেলায় এক হাজার ৪৫৭ টি গভীর নলকূপ সচল এবং ৬১টি বন্ধ রয়েছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তাহমিনা পারভীন বলেন, ‘এটি শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়, সারা দেশেরই সমস্যা। এই সময়ে পানির সঙ্কট থাকে। পানির স্তর নিচে নেমেছে। নলকূপ ও মোটরে পানি না আসার বিষয়টি অনেকে জানিয়েছেন। প্রচণ্ড গরম, বৃষ্টি না হওয়া এবং বেশিরভাগ নদী-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা প্রকট হয়েছে।’
আরো পড়ুন