ভবনে র্যাম্প:আইন ও সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা
।। আবদুল আজিজ মাসুদ ।।
গত ১২ ডিসেম্বর সংখ্যা সাপ্তাহিক আমোদ-এ ভবন সমূহে র্যাম্প বা সিঁড়ির পার্শ্বে হুইল চেয়ার চলাচলের রাস্তা না থাকায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের কথা লিখেছেন মহিউদ্দিন মোল্লা। এটি একটি সময়োপযোগী প্রতিবেদন।
জানা যায়, আমাদের দেশের প্রায় অর্ধ কোটি প্রতিবন্ধী রয়েছে। পিছিয়ে থাকা এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের অবহেলা, অনীহা ও বৈষম্য তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অথচ আমাদের সংবিধানে ১৯(১) নং অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে, ” সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেতন হইবেন।” এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ২৯(৩) ( ক) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ” নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব ল্ভা করিতে পারেন,সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবেনা। ” অর্থাৎ আমাদের সংবিধান প্রতিবন্ধীসহ দেশের সব অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। তাছাড়া এ লক্ষে প্রণীত হয়েছে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ এবং প্রতিবন্ধী কল্যাণ বিধিমালা ২০০৮। উক্ত আইনের তফসিল ‘ছ’তে বলা হয়েছ, “প্রতিবন্ধীদের যাতায়াত ও যোগাযোগের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত কল্পে সরকারি সংবিধিবদ্ধ ও বেসরকারি সংস্থার ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা এবং যানবাহনে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা এবং এ অংশের ৫ এ রয়েছে ” হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রযোজ্য স্থানে ঢালু ও বাঁকানো রাস্তা সিঁড়ি ও র্যাম্প নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করা। এই আইনের ১৭ বিধিতে রয়েছে, ” সকল সরকারি ও বেসরকারি ইমারত সমূহে প্রতিবন্ধীসহ সার্বজনীন গম্যতার ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, আবাসিক ইমারত সমূহের ক্ষেত্রে প্রতিটি ইমারতের অনুন্য ৫% স্থানে উক্ত ব্যবস্থা থাকিলে চলিবে”।
অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ইমারত নির্মাণের সময় প্রতিবন্ধীদের সর্বত্র গম্যতার সুযোগ সুবিধা না রেখেই ইমারত নির্মাণ সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের প্রতি বরাবরই রয়েছে উদাসীনতা অথচ একটু সচেতন হলেই আমাদের এই বিরাট অবহেলিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সর্বত্র গম্যতা অনেকাংশে সহজতর হয়। ভবনের মূল প্রবেশ পথে র্যাম্প থাকলেই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধীগণ অন্যের সাহায্য ছাড়াই বহুতল ভবনের লিফট এর দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারে। আর তা হলেই বহুতল ভবনের সর্বত্র চলাচলে তেমন প্রতিবন্ধকতা থাকেনা।
উন্নত বিশ্বে যানবাহন বলুন আর স্থাপনাই বলুন সর্বক্ষেত্রে প্রথমেই প্রতিবন্ধী বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে নকশা তৈরি ও অনুমোদন করা হয়। গণ পরিবহনে প্রতিবন্ধী পেনশনভোগীদের জন্য প্রায়োরিটির ব্যবস্থা থাকে। আছে হুইলচেয়ারসহ গণ পরিবহনে প্রবেশের ব্যবস্থা। তাদের ফুটপাথ গুলো এমন উচ্চতায় তৈরি ফুটপাত থেকে সহজেই হুইলচেয়ার চালিয়ে কারো সাহায্য ছাড়াই পরিবহনে প্রবেশ করা যায়। ব্যাটারি চালিত হুইলচেয়ার নিয়ে প্রতিবন্ধীরা শপিং মলে অবাধে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করতে দেখেছি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিপণীবিতান, অফিস সমূহে প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে পৃথক লিফট। অথবা লিফট গুলোর বোতাম এমন উচ্চতায় স্থাপন করা হয় যাতে হুইলচেয়ারে বসেই নিজ হাতে বোতাম টিপা যায়। ওয়াশরুম, টয়লেট গুলোও তাদের ব্যবহার উপযোগী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা যাতে কেউ কোন ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার না হন।
আমাদের মেট্রোরেল, আন্তঃনগর রেল স্টেশন গুলো প্রতিবন্ধী বান্ধব বলা গেলেও নগর পরিবহন ও আন্তঃনগর বাস সার্ভিস গুলো সে ভাবে প্রতিবন্ধী বান্ধব হয়ে উঠেনি। নগর পরিবহন গুলোতে প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকলেও প্রতিবন্ধী প্রবেশ দূরহ ব্যাপার। কারণ হিসেবে বলা যায় অপরিকল্পিত ফুটপাত, যানবাহন তৈরিতেও প্রতিবন্ধী বান্ধব না হওয়া।
লেখক : আইনজীবী,বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।