হারিয়ে খুঁজি আমার শৈশব
মাহফুজ নান্টু।।
ঝলমলে বিপনী বিতান। বেলা যত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। ভিড়বাট্টা বাড়ছে। ঈদ ঘনিয়ে আসছে। সবাই পছন্দমতো জুতো জামা কিনছেন। কেউ কেউ স্বজনদের সাথে মোবাইল ফোনে ভিডিও কলে জামা জুতার সাইজ রঙ দেখে পছন্দ করছেন। আমার পা ব্যাথা। তাই বিপনী বিতানের একপাশে বসে আছি। তাইয়্যবা তাকওয়া তার মায়ের সাথে নতুন জামা জুতো পছন্দ করছেন। মেপে দেখছে বড় ছোট হবে কি না। রঙটা ভালো কি না। তাইয়্যবা তাকওয়ার খুশি যেন উপচে পড়ছে। একবার এদিকে দৌড় দিচ্ছে আরেকবার ওই দিকে দৌড় দিচ্ছে। মেয়েদের এমন ছুটাছুটি দেখে তানিয়া খুব বিরক্ত। মুখে প্রচন্ড বিরক্তির ভাব এনে দু মেয়েকে কষে ধমক দিলেন। আমি তাদের এমন খুনসুটি মুগ্ধ হয়ে দেখি।
আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে। আমার শৈশবের বেশির ভাগ ঈদ এসেছিলো শীতের সময়ে। ছোট দিন। রাত বড়। আমরা ভোররাতে ঘুম থেকে উঠতাম। কুয়াশাঘেরা উঠোনের কোনায় রান্না হতো। দলবেঁধে মা চাচিরা টিউবওয়েল চেপে সবাই পানি আনতে যেত বাড়ির সামনে। মসজিদের মাইকে ইমাম সাহেব মায়াবি গলায় সুর করে গজল গাইতেন। শীতের কুয়াশা ভেদ করে কানে এসে লাগত সেই গজল। ‘উঠো মুমিন মুলসমান। রমজানে রহমতে দিদার কেহ পাইবো আর।’ বড় মধুর সুর। ইফতারের সময় ইমাম সাহেব মসজিদের মাইকে বলতেন- সবাই ইফতার সামনে নিয়ে বসেন। ইফতারের আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি আছে। এখন মসজিদে সরাসরি আযান দেয়া হয়। আযান শুনেই এখন সবাই রোজা ভাঙ্গে।
আমার দাদা পুরো রমজানমাস ইতেকাফ করতেন। আমার দায়িত্ব ছিলো ভোররাতে দাদার জন্য ভাত তরকারি নিয়ে যাওয়া। মসজিদে যাওয়ার পর দাদা আমাকে খুরমা খেজুর দিতেন। কখনো জিলাপি দিতেন। মসজিদে মিলাদ হতো। তাবারুক হিসেবে পাওয়া খেজুর জিলাপি আমার জন্য রেখে দিতেন। সেসব খেজুর আর জিলাপির লোভেই আমি ভোররাতে দাদার জন্য ভাত তরকারি নিয়ে যেতাম। দাদার কাছ থেকে পাওয়া খুরমা খেজুর, বাতাসা কিংবা জিলাপি আমার কাছে অমৃত মনে হতো। এখন দাদা নেই।
আমাদের শৈশবে কে কতটা রোজা রাখতে পারতাম, কে কার আগে কোরান খতম করতে পারতাম তা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা হতো। বড়দের অতি আদরের কারণে অনেক সময় রোজা রাখতে পারতাম না। শুকিয়ে যাবো কিংবা অসুস্থ হয়ে যাবো বলে রোজা রাখতে দিতেন না। এতেই পিছিয়ে যেতাম প্রতিযোগিতায়। তবে দিনের বেলায় উঠানে রোদ পোহাতে পোহাতে সুর করে কোরান তেলোয়াত করতাম। কোরান খতমের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতাম। আমাদের শৈশবে কোরান শরীফের ভেতর যতœ করে ময়ুরের পাখনা রেখে দিতাম। কে কত সুন্দর ময়ূরের পাখনা রাখতে পারে তা নিয়েও প্রতিযোগিতা হতো।
এখন রোজার প্রথমেই সবাই শপিং শুরু করে। আমাদের শৈশবে শেষ দশদিনে সবাই ঈদের নতুন জামা কাপড় কিনতেন।
আমারা পিঠাপিঠি চার ভাইবোন। অভাবের সংসারে সব ঈদে নতুন জামা কাপড় কেনা সম্ভব হতো না। একবার কিনতে পারলে আরেকবার কেনা হতো না। এ নিয়ে আমাদের মন খারাপ হতো না। ঈদের দিন ঈদের নামাজ শেষে সবাই মিলে গরুর মাংশ দিয়ে ভাত খাওয়া সেলামী নেওয়ার মাঝেই আমাদের ঈদের আনন্দ ছিলো। পুরো গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম। সে সময় ১০/১৫ টাকা সালামী পেতাম। এই টাকা দিয়ে কাঠি আইসক্রিম, বেলুন কিনতাম। কি যে আনন্দ ছিলো।
একবার আব্বু চিঠিতে লিখলেন ঈদের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। সে টাকা ঈদের আগে এসে পৌঁছাবে না। আম্মা তার জমানো তিনশ’ টাকা আমার হাতে তুলে দিলেন। বাজার করতে হবে। সেই টাকা দিয়ে সেমাই চিনি,নারকেল, একটা মোরগ, গরুর মাংশসহ যা প্রয়োজন তা সবই কিনলাম। শুধু কেনা হয়নি আমাদের নতুন জামা জুতো। এ নিয়ে আম্মার অনেক মন খারাপ হয়েছিলো। শপিং মলে বসে আমি ফিরে যাই আমার অতীতে।
এমন ভাবনার মাঝে তানিয়ার ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। তাইয়্যবা তাকওয়াসহ সবার জন্য নতুন জামা জুতো কেনা হয়েছে। এখন বাড়ি ফেরার পালা। আমি তাইয়্যাবা তাকওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। তাদের আনন্দ দেখে খুঁজে ফিরি আমার হারানো শৈশব। যেখানে শত অভাবের মাঝেও আমরা চার ভাই বোন, আম্মা, আব্বু, আমাদের চাচা চাচি ফুফি মিলে কত আনন্দ করতাম। এখন দাদা নেই। আব্বু নেই। তারা এখন ওপারে। সংসারী হওয়া আমার দুই বোন স্বামীর বাড়িতে ঈদ করেন। ভাইয়াও থাকেন দূরে। এখন আমি একা বাড়িতে। রমজান আসে রমজান যায়। আমি স্মৃতির ডায়রি খুলে খুঁজে ফিরে আমার হারানো শৈশব…।
লেখক: এনটিভি,কুমিল্লা প্রতিনিধি।