পত্রিকার সাথে প্রেম

  ।। ড. সফিকুল ইসলাম ।।
ছোটবেলার সকালগুলো যেন শুরু হতো একটাই শব্দে”পত্রিকা এসেছে!” মুরব্বিরা কেউ দরজার নিচে ঢুকিয়ে রাখা সংবাদপত্র হাতে তুলে নিতেন, আর পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম কখন তাঁরা প্রথম পাতার খবর পড়ে পাশের পাতায় যাবেন। তখনই আমি ঝট করে প্রথম পাতার বড়সড় হেডলাইনটা পড়ে নিতাম! তখনও বোঝার ক্ষমতা ছিল না, তবু খবরের কাগজের গন্ধ, কালি আর কাগজের মিশ্র গন্ধটা যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি করত। সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাসটা একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়। স্কুলে ‘কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স’ পড়তে হতো, আর ক্লাসে কেউ যদি বলে বসে, “আজকের ‘সম্পাদকীয়’ পড়েছ?”তখন মনে হতো, এই বুঝি নিজেকে “বড়দের মতো” মনে করার সুযোগ এসেছে!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রতিদিন সকাল শুরু হতো পত্রিকা পড়া দিয়ে। আমাদের কয়েকটি রুম মিলে ছিল পত্রিকা কর্নার। যেটার নাম ছিল পেপার রিডার্স এসোসিয়েশন (প্যারা)। সবাই মিলে অনেকগুলো পত্রিকা রাখতাম। লাইব্রেরিতে বা কমনরুমে পড়ার জন্য দাাঁড়িয়ে থাকতে হতো, তাই নিজেরাই জহুরুল হক হলের তিন তলায় আমাদের কয়েক রুম মিলে এ আয়োজন। সংবাদপত্র হয়ে ওঠে মতামত গঠনের হাতিয়ার। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, সাহিত্য সমালোচনা, পাঠকপত্র সব কিছুই যেন ভাবনার নতুন জানালা খুলে দিত। কখনো কোনো কলাম পড়ে মনে হতো, “এই লেখক যেন আমার মনের কথাই লিখে ফেলেছেন!”আবার কখনো তীব্র প্রতিবাদে ভরে উঠত মন। বন্ধুদের অনেকে খেলার পাতায় সময় দিতো বেশি, বড় ভাই দুয়েকজন বুদ্ধিবৃত্তিক কলাম পড়তো। আর আমার ভালো লাগতো নানা বিষয়ে ফিচার বা সাহিত্য পাতা বা শিক্ষা ও বিনোদন পাতা। তখন পত্রিকার প্রতি নেশা হয়ে গিয়েছিল। পড়ার নেশা, প্রেমের নেশার মতোই পত্রিকার নেশা। যায় যায় দিনের ভালোবাসা দিবস সংখ্যাগুলো এখনও হাতছানি দেয়! ক্যাম্পাসে থাকার সময়ে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে লিখতাম, সেই থেকে হাতেখড়ি। প্রথমবার চিঠিপত্র বিভাগে লেখা ছাপা হওয়ার সময় কী যে আনন্দ হয়েছিল। প্রথম প্রেমের প্রস্তাব পাওয়ার মতোই আনন্দ। এরপরে কবিতা বা ফিচার পাঠাতাম। দৈনিক ইত্তেফাকে ও ভোরের কাগজে লেখা ছাপা হতো। আবার যাকে ভেবে কবিতা লিখতাম, প্রকাশিত কবিতা তার কাছেও পাঠাতাম! তা ছাড়া যায় যায় দিনে পাঠাতাম বানিয়ে বানিয়ে প্রেমের গল্প। যত বেশি বানানো, যত বেশি ফ্যান্টাসি থাকতো লেখায়, ছাপা হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়তো। লিখতে হতো এমন করে যেন বাস্তব আবেগের রসে ভরা।
পত্রিকা পড়ে পড়ে তাঁদের ভাবতাম যারা পত্রিকায় লিখে, ছাপার কাজ ও সম্পাদনা করে। তাঁদেরকে খুব সমীহ করতাম। কল্পনা করতাম যে এক কাপ চা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, বসে বসে সম্পাদনা আর হাতে ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে কিছু লোক ব্যস্ত-এমন দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। আমাদের মধ্যে কারও কারও একটা অভ্যাস ছিল, ভালো লাগা প্রতিবেদন কেটে রেখে দেওয়া। কলেজে পড়ার সময় নায়ক নায়িকা ও খেলোয়াড়দের ছবি কেটে কেটে জমাতাম। আবার পড়ার টেবিলের সামনে ভাত-গাম দিয়ে লাগিয়ে রাখতাম। প্রযুক্তির হাত ধরে সংবাদপত্র আজকাল মোবাইল স্ক্রিনে। ক্লিক করলেই খবর। তবু সেই সকালে কাগজ ছুঁয়ে দেখার মজাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অনলাইনে সংবাদপত্র পড়া সহজ, কিন্তু তাতে যেন একটু ‘আবেগ’ কম। আজও রোদেলা সকালে বারান্দায় বসে কাগজ হাতে সময় কাটাতে ভালো লাগে। হয়তো সব খবর জানা, তবু কাগজ ও পৃষ্ঠা উল্টানোর অভ্যাসটা থেকে যায়। কারণ, সংবাদপত্র কেবল খবর নয়। এ যেন জীবনের একটা অদৃশ্য সংযোগ, স্মৃতির পাতা ও সময়ের ছাপ রাখা এক অমূল্য দলিল।
তেমনই একটি পত্রিকা হলো সাপ্তাহিক আমোদ। আমোদ’র সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৬ সালে। যখন আমি কুমিল্লা বোর্ডে গিয়েছিলাম, হারানো এসএসসি সনদ তোলার জন্য। বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল একটি। তখনই সাপ্তাহিক আমোদ’র প্রেসে গিয়েছিলাম। বিজ্ঞপ্তিসহ পত্রিকাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে বিজ্ঞপ্তিটি পড়েছি, সাথে পত্রিকার বাকিপাতাগুলোও পড়ে ফেলেছি। একটি ভালো লাগা তৈরি হয়। জানলাম যে, কুমিল্লা অঞ্চলের এটি ঐতিহাসিক ও প্রভাবশালী স্থানীয় পত্রিকা, যা ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কুমিল্লাসহ আশপাশের অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে এটি কাজ করে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই পত্রিকাটি স্থানীয় লেখক, কবি এবং সাহিত্যিকদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। অনেক নবীন ও প্রবীণ লেখকের লেখালেখির সূচনা বা প্রসার হয়েছে এই পত্রিকার মাধ্যমে। বিশেষ করে কুমিল্লার সাহিত্যচর্চার একটি প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এটি। কুমিল্লার গুণী সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোকপাত করে নিয়মিত। মৃত্যুর পরে অনেক সাহিত্যিকের কাজ ও অবদানের ওপর স্মৃতিচারণমূলক লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁদের পরিচিতি টিকিয়ে রেখেছে। আমি নিজেও কুমিল্লায় দুবছর কর্মকালে যেসব সাহিত্যের আয়োজন হয়েছে, সেগুলো নিয়ে নিয়মিত ফিচার করেছে সাপ্তাহিক আমোদ। তৃতীয়ত, সাপ্তাহিক আমোদ কুমিল্লার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে নিয়মিতভাবে তুলে ধরেছে। ফলে স্থানীয় ইতিহাস সংরক্ষণে এটি একটি তথ্যভা-ার হিসেবে কাজ করছে। কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থান, লোককথা, ধারাবাহিক ইতিহাস, আঞ্চলিক সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করে। শালবন বিহার, ধর্মসাগর, ময়নামতি, মন্দির, বৌদ্ধবিহার, বার্ড ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী স্থানের সংরক্ষণ ও গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা উঠে আসে পত্রিকাটিতে। চতুর্থত, পত্রিকাটি দুর্নীতি, সামাজিক অনাচার, বৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে। ফলে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর জনচাপ সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় পরিবর্তনের পথে সমাজকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখে। পঞ্চমত, কুমিল্লা অঞ্চলের রাজনীতিতে, বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক বিতর্কে, সাপ্তাহিক আমোদ অনেক সময় মতামত এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এটি রাজনৈতিক চেতনা গঠনে অবদান রেখেছে। ষষ্ঠত, পত্রিকাটি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকট, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্থানীয় ঘটনা, ও কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি এক ধরনের স্থানীয় ইতিহাস সংরক্ষণাগার। সপ্তমত, নবীন ও প্রবীণ লেখকদের জন্য লিখবার একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ইত্যাদির মাধ্যমে বহু লেখক তাঁদের সাহিত্যিক পথচলা শুরু করেন এই পত্রিকার মাধ্যমে। এমনকি অনেক জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিকের শুরুর লেখা এই পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল। অষ্টমত, স্থানীয় কিংবদন্তি ও লোকসাহিত্য সংরক্ষণে আমোদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। অনেক পুরনো লোকগান, পালাগান, পুঁথি সাহিত্য, এবং কিংবদন্তির পুনর্প্রকাশ ঘটে এই পত্রিকায়। এগুলো কুমিল্লার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ইতিহাসকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। আঞ্চলিক সংবাদপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক আমোদ অনন্য।
পৃথিবীর সকল পত্রিকার মালিক, প্রকাশক, সম্পাদক, পৃষ্ঠপোষক ও পাঠকদের ধন্যবাদ জানাই। আর সাপ্তাহিক আমোদ’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা রইলো।
লেখক:কবি ও সাহিত্যিক।

inside post

[email protected]

আরো পড়ুন