গণমাধ্যমের শক্তি!

।। ইলিয়াছ হোসাইন।।

এক।।
দু’হাজার বাইশ। বর্ষাকাল। শ্রাবণের বৃষ্টিতে ঘরের চাল বেয়ে পানি পড়ছে। ভেতর টইটুম্বুর অবস্থা। নড়বড়ে ঘর। সামনে দূর্গন্ধযুক্ত পঁচা পানি। বর্ষায় সাপের ভয়। এখানে মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়,তবুও বছরের পর বছর বসবাস করছে একটি পরিবার। সেই দৃশ্যের বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি ধারণ করি। পত্রিকার পাতায় ছাপানোর জন্য এই করুণ দৃশ্য কিভাবে যে কলমে শুরু করবো ভেবে পাচ্ছিলামনা। এক সপ্তাহ চলে গেলো। ফিচার নিউজ। নিউজের বডি লিখে ফেললাম। কিন্তু শুরুটা যে কিভাবে লিখলে পাঠকের মনকে আকর্ষিত করবে সেটাই ভাবছি। মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ার শরণাপন্ন হলাম। ভাইয়াকে অনুরোধ করলাম শুরুটা লিখে দিতে। মঙ্গলবার রাতে ভাইয়াকে ছবিসহ লিখা পাঠালাম। বুধবার পত্রিকার মেকাপ। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকার শিরোনাম ছাপা হয়েছে ‘বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি!’পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের আসমানি কবিতার প্রথম চার লাইন দিয়ে শুরু। খবরের সূচনা আমাকেও মুগ্ধ করেছে। যে নিউজ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জেলায়। পরের দিন স্থানীয় চেয়ারম্যান বাড়িটির দর্শনে গেলেন। খবরের পাতার সাথে পুরোপুরি মিল পেলেন। ভুক্তভোগী পরিবারকে সরকারের প্রকল্প থেকে ঘর দেওয়ার আশ্বাস দিলেন। এছাড়া নিউজের ফলে ব্যক্তিগত ভাবেও এগিয়ে আসলেন অনেকেই। গল্পের আসমানিরা নতুন আশ্রয় পেলেন। সুন্দর একটি ভালোবাসার ঘর।
দুই।।
চব্বিশের বন্যায় গোমতীর ভয়ঙ্কর রূপ;যা দেখতে হাজারো মানুষের ভিড়। সহস্র মানুষের নিঃশব্দ গোঙ্গানি এ খরস্রোতা স্রোতে ভাসমান। হাজারো পরিবারের স্বপ্ন ডুবে গেছে জলে। নদীর বাঁধ ভেঙেছে, ভেসে গেছে সহস্র মানুষের ঘরবাড়ি। গোমতী নদীরপাড়ের মানুষরা রাস্তায় সামিয়ানা টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরের ছাদ তলিয়ে গেছে। গণমাধ্যম কর্মীদের ঘুম নেই;টেলিভিশন,পত্রিকায় প্রতিনিয়ত আপডেট দিতে ব্যস্ত। ভোগান্তি মানুষের আতঙ্ক কাটাতে নদীর পানির অবস্থা মুহূর্তে মুহূর্তে জানাচ্ছেন;এর সাথে গুজবের সাথেও লড়াই। বুরবুরিয়া বাঁধ ভেঙে গেলো। বুড়িচং উপজেলা প্লাবিত হচ্ছে। সারাদেশে খবর ছড়িয়ে গেলো। ফেইসবুক জুড়ে কুমিল্লা,ফেনীর বন্যার খবর ভাসছে। শুকনো খাবার নিয়ে আমিও একটা টিম প্রস্তুত করে চলে গেলাম। দেখলাম দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষের জন্য প্রাণ ভাসানো হাজারো স্বেচ্ছাসেবী। স্রোত ঠেলে কেউ উদ্ধার করছে, কেউ খাবার পৌঁছে দিতে জীবনবাজি রাখছে,কেউ আবদ্ধ মানুষের নিকট পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মহিষমারা বাজার গিয়ে ঠেকলাম। সেখান থেকেই আমোদ’র পেইজে সরাসরি যুক্ত থেকে দেশের মানুষকে দেখানোর চেষ্টা করলাম সেখানকার বর্তমান অবস্থা। আটকে থাকা ঘরবাড়ি থেকে ট্রাকে ট্রাকে শত শত মানুষ বের করে আনছেন উদ্ধার কর্মীরা। সেনাবাহিনীর স্পিড বোটও থেমে নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধা সকলে তাকিয়ে আছেন, আতঙ্ক চোখে। চোখে মুখে প্রিয় জিনিস হারানোর চাপা কষ্ট ভাসছে। দিবসের আলো নিভে আসছে। মানুষের নিঃশব্দ যন্ত্রণা রাতের গভীরতার সাথে বাড়তে শুরু করলো। ভয়ঙ্কর স্রোতের গর্জন ঘুমের মধ্যে বেজে উঠছে। ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে ভাবি বানভাসিরা কতোটা আতঙ্কে রাত পার করছেন। ঘুম নেই। এভাবে মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট উপজেলায় ছুটলাম। মানুষকে পানিবন্দি মানুষের কষ্টের কথা জানানোর চেষ্টা করলাম।
ফোনে মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়া বললো তুমি যা দেখছো,যা করছো তা লিখো। আমি লিখেছি মানুষের চোখের কোণের অশ্রু! স্রোতের উপাখ্যান। মানুষের স্বপ্ন,আশ্রয়স্থল মাটিতে মিশে যাওয়ার গল্প। শুধু আমি নয়,সকল গণমাধ্যম কর্মী লিখেছেন,বুম হাতে বলতে বলতে কন্ঠস্বর ফাটিয়েছেন। যার ফলে নৌকার সংকট,খাবার সংকটের কথা সকলের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে গেছে। উদ্ধারে হতাহতের খবর তেমন শুনতে হয়নি। এ পুরোটাই গণমাধ্যমের মহা শক্তি বলা যায়।
একটি খবর একজন নিরুপায় মানুষের শক্তি;আর একটি পত্রিকা একটি দেশের লাখো মানুষের দুঃখ,কষ্ট,যন্ত্রণা দূরীকরণের শক্তি। এ শক্তির খোঁজ আমি মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। যিনি সহজ মানুষ। যার চোখ সবসময় ব্যতিক্রম বিষয় খুঁজে। যাকে খুব সহজে,সরলতায়,সততায় চিনে ফেলা যায়।
তিনিই আমার সংবাদ লিখার শিক্ষক। কি বর্জন করতে হবে,কি যোগ করতে হবে ওনার কাছ থেকেই শিখছি, শিখতেছি,বাদ বাকি সময়ও শিখে যাবো। মানুষকে হয়রানি করা নয়,গণমাধ্যমে মিলবে গণমানুষের মুক্তি!
লেখক:সংগঠক ও আলোকচিত্রী।
সাধারণ সম্পাদক,রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম।