সবুজ কুমিল্লার স্বপ্নে কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটি

আলাউদ্দিন আজাদ

কুমিল্লার সব ছাদ,ব্যালকনি গুলো ঢেকে যাবে সবুজ ছাউনিতে। ছাদেই ফলবে লাউ, কুমড়ো, শিম। ফুটবে গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলী। খাদ্য তালিকায় যোগ হবে নিজ বাগানের তাজা শাক সবজি, ফল আর মন ভরবে ফুলের সৌন্দর্য সৌরভে। এমন স্বপ্ন নিয়েই পথ চলা শুরু ফেসবুক ভিত্তিক ছাদবাগানীদের সংগঠন কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটি’র। সংগঠনটি সংক্ষেপে সিজিএস  নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় শুরু হয় এমন দু’একটি সংগঠনের। সেসবের পাশাপাশি কুমিল্লার বাগানীরা এমন একটি প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। সবুজে থাকুন, সবুজে বাঁচুন এই স্লোগান নিয়ে ২৬ আগস্ট ২০১৭ থেকে পথচলা শুরু সংগঠনটির। শুরুতে সদস্য সংখ্যা ২০০’র মতো থাকলেও বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৬,৫০০।

ছাদ বাগানীদের বাগানের নানান সমস্যায় পরামর্শ, নিজেদের মাঝে গাছের আদান প্রদান করে থাকে সংগঠনটি। নতুন বাগানী সৃষ্টির প্রয়াসে প্রতি মাসেই নতুন বাগানীদের মাঝে সবুজ উপহার তুলে দেয়া হয়।

কথা হয় সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এডমিন ডা. আবু নাঈমের সাথে। পেশায় চিকিৎসক, বর্তমানে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক এবং একজন সবুজমনা মানুষ। গড়ে তুলেছেন কুমিল্লাতেই দেশজ গ্রাউন্ড অর্কিড এর বিশাল সংগ্রহশালা। তাঁর বাগানে প্রায় পাঁচ শতাধিক গাছগাছালি রয়েছে। দেশ বিদেশের অর্কিড, দুষ্প্রাপ্য গাছ, লতানো গাছ, ইনডোরের গাছ, ফল গাছ দিয়ে নিজের বাড়িটি সাজিয়েছেন। একটু খানি জায়গাও খালি রাখেননি।
ডা. আবু নাঈম জানালেন, তিনি সহ বর্তমানে সংগঠনটির এডমিন মডারেটর আছেন আরো ছয় জন। ডা.তালেয়া চৌধুরি, তাওহিদা আক্তার, রায়হান আবেদীন, শারমিন আক্তার, কামরুন নাহার মিমি, ডি. কৃষিবিদ মোসলেহ উদ্দীনসহ একঝাঁক উদ্যমী বাগানী সংগঠনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ডা. আবু নাঈম

কেন এমন একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ডা. আবু নাঈম জানান, ছোটবেলা থেকেই তিনি গাছ গাছড়া, বাগান, প্রকৃতি ভালোবাসতেন। চিকিৎসা বিদ্যা যেমন মানবিক হতে শিখায় তেমনি বাগান মানুষকে মানবিক গড়ে তুলে। বাগান করা কেবল শখ নয় প্রয়োজন বটে। আমরা যারা কুমিল্লায় বাগান করি, আমাদের নিজেদের পরিচিত হওয়া, বাগান সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান, গাছ অদলবদল করার জন্য এমন একটি প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন ছিলো।
প্রতিবছর দুই থেকে তিনটি ইভেন্টের আয়োজন করে থাকে সংগঠনটি। ইভেন্ট বলতে মূলত বুঝানো হয়, বাগানীদের একত্রিত হয়ে নিজেদের মাঝে গাছ আদান প্রদান। যা এক প্রকারের মিলন মেলা। সংগঠনের এডমিন প্যানেল এবং কিছু সজ্জন সবুজ প্রেমী অভিভাবকদের সহযোগিতায় বাগানোদের মাঝে ফুল, ফল, ঔষধি গাছ এবং শস্যবীজ বিনা মূল্যে উপহার দেয়া হয়।

এছাড়াও জেলা কৃষি বিভাগ, জেলা প্রশাসনের সম্পৃক্ততায় কুমিল্লায় ছাদকৃষি কর্মশালা আয়োজন করেছে সংগঠনটি।
বাগানীদের উৎসাহ দিতে সংগঠনটি আয়োজন করে থাকে নতুন বাগানী প্রতিযোগিতা, সেরা বাগানী প্রতিযোগিতা, ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা। বছরজুড়ে নানা আয়োজনে জমজমাট থাকে গ্রুপটির দেয়াল। কেবল বাগান বিষয়ক পোস্ট নয়। শুক্রবারে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক নানা আকর্ষণীয় পোস্টে ভরপুর থাকে প্ল্যাটফর্মটি।

নতুন প্রতিষ্ঠিত লালমাই উদ্ভিদ উদ্যানে সংগঠনটি আয়োজন করে ” বৃক্ষ সন্দর্শন” আয়োজনের। কেবল গাছ চেনানোর জন্য প্ল্যাটফর্মের সদস্যদের নিয়ে এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জনাব কাজী নুরুল করীম।

সংগঠনটি ভবিষ্যতে কুমিল্লার ছাদবাগানীদের একটি ছাদকৃষি করেন এমন ডাটাবেইজ করার প্ল্যান রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে কুমিল্লা নগরীতেই অন্তত ৫০০-১০০০ এর বেশি বাগানী রয়েছেন যারা নিজের বাগানের সবজি দিয়েই চাহিদা মিটিয়ে থাকেন।
এছাড়া অনেকে ব্যালকনিতেও বাগান করছেন।

ছাদবাগান করতে কেমন জায়গা এবং কেমন মাটি প্রয়োজন জানতে চাইলে ডা. আবু নাঈম জানান,
নূন্যতম ৯০০-১০০০ বর্গফুট ছাদেও ভালভাবে বাগান করা সম্ভব। ফ্রেশ সবজির পারিবারিক চাহিদা মিটে যাবে। মাটি হিসেবে বেলে দো আঁশ মাটি হবে আদর্শ। মাটি সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে বলেও গুরুত্ব দেন তিনি।

ভবিষ্যৎ এ প্ল্যাটফর্ম টিকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেন জানতে চাইলে জানান, কুমিল্লার সব ছাদ হবে একেকটি বাগান। কোন খালি ছাদ থাকবেনা। বিদেশি ভালো জাতের আপেল, নাশপাতি, বেরি, পার্সিমন, আমের ভালো জাতের চারা যদি সরকারি ভাবে কিংবা প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগেই কুমিল্লার বাগানীদের হাতে পৌঁছে দেয়া । যেহেতু জেলা কুমিল্লায় এসব গাছ সুলভ নয়। অন্যান্য ফলজ গাছের দাম ও নার্সারিতে বেশ চড়া। তাই সেসব গাছ সুলভ করা। প্রতিটি ব্যালকনিতেই থাকবে ফুলের গাছ, ঝুলন্ত টব। সংগঠনটির উদ্যোগে ছাদকৃষি এবং বাগানকেন্দ্রিক পরামর্শ মূলক সাপ্তাহিক সিম্পোজিয়াম এর আয়োজন করা। দুষ্প্রাপ্য গাছ সমূহের সংগ্রহ শালা কুমিল্লার কোথাও গড়ে তোলা। প্রকৃতি ও বৃক্ষ প্রেমীদের নিয়ে একটি ন্যাচার স্টাডি ক্লাব গড়ে তোলা।

 


কথা হয় কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটির সদস্য ডা. নার্গিস আক্তারের সাথে। পেশায় স্ত্রীরোগ প্রসূতি বিদ্যা বিশেষজ্ঞ তিনি। বাগান করছেন প্রায় ২০ বছর। নগরীর ঠাঁকুরপাড়ায় পাঁচতলা বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছেন এক সবুজ সাম্রাজ্য। তিনি জানান, তাঁর দিন শুরু হয় বাগান দিয়েই। ফজর নামাজ আদায়ের পর বাগানে হাঁটাহাঁটি এবং গাছে পানি দিয়ে দেয়া প্রাত্যহিক কাজ। দিনভর অফিস, চেম্বার শেষ করে যত ব্যস্ততা থাকুক রাতে ফিরেও বাগান দেখাশোনা করেন তিনি। নিজের পারিবারিক চাহিদার সব্জীর প্রায় সবটাই মিটে যায় বাগান থেকে।
ছবি তুলে সেসব তিনি পোস্ট করেন কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটিতে। ডা. নার্গিস আক্তার বলেন, শত ব্যস্ততার মাঝেও আমি বাগান করার সময়টা বের করে নেই বা নিয়েছি। অবসর গ্রহণের সময় এসেছে চাকুরির। এরপর বাগান টাই হবে আমার পুরোপুরি সময় কাটানোর জায়গা।

একজন চিকিৎসক হিসেবে এই মহামারী করোনাকালে আমি সবাইকে বাগান করতে বলব৷ বাসায় অলস বসে না থেকে স্থানীয়ভাবে, কুমিল্লার সবাইকে কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটির সহযোগিতায় সবার বাগান করা উচিত।
শহরের ঢুলিপাড়ায় বাগান সালমা আমীনের। পেশায় শিক্ষক এই বাগানী জানান, কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমার বাগানটি কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে।


এছাড়াও ছাদ কৃষির সকল পরামর্শ খুব সহজেই পেয়ে যাই। প্রায় ১৫০’র উপর নানা ফল ও ফুল গাছ রয়েছে বাগানে। নিজের পরিবারের চাহিদা বাগান থেকেই সিংহভাগ মিটে যায়।
কেবল শহর নয়, সারা কুমিল্লা জেলার প্রায় উপজেলার বাগানীরাই এর সদস্য। লাকসামের বাসিন্দা এবং বাগানী রবিন খাইরুল আনাম জানান, কুমিল্লা গার্ডেনার্স সোসাইটির একজন সদস্য তিনি।
এত সবুজ উপহার খুব কম প্ল্যাটফর্ম দিয়ে থাকে দেশের।

লেখক: আলাউদ্দিন আজাদ
সাবেক সম্পাদক, ক্যাম্পাস বার্তা
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ