আজন্ম সুর সন্ধিৎসু ‘খাঁ সাহেব’

inside post
।।  এইচ.এম. সিরাজ ।।
আলাউদ্দিন খাঁ। একটি নাম-একটি বিস্ময়-একটি ইতিহাস। তিনি বিশ্বখ্যাত সুরসম্রাট। যে ক’জন ব্যক্তির সুবাধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাংলাদেশের সংস্কৃতির রাজধানী-সুরের জনপদ নামে সমধিক পরিচিত, তিনি তাদেরই একজন কিংবা অন্যতম। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার চির ঐতিহ্যময় শিবপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রবাদপুরুষতূল্য ‘খাঁ সাহেব’, আজন্ম সুর সন্ধিৎসু সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তিনিই হলেন প্রথম বাঙালি, যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে তথা গোটা বিশ্বজুড়ে ভারতীয় উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিতি এবং প্রসার ঘটিয়েছিলেন। ৬ সেপ্টেম্বর খাঁ সাহেবের মহাপ্রয়াণ কিংবা মৃত্যু দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই সুর স্রষ্টাকে।

 —
আজ হতে দেড়শ’ বছরেরও আগের কথা, ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সমৃদ্ধ গ্রাম শিবপুরকে আরো ধন্য করতেই জন্মেছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। যার ডাকনাম ছিলো আলম। পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁ নিজেও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। মাতার নাম সুন্দরী বেগম। বাল্যকালে অগ্রজ ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ’র কাছেই তাঁর সঙ্গীতে হয়েছিলো হাতেখড়ি। সুরের সন্ধান যেনো তাঁর আজন্ম স্বভাবজাত। তাইতো অনেকটা শিশু বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাত্রাদলের সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। সেই সময়েই তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সাথে হন পরিচিত। তাঁর সঙ্গীতগুরু ছিলেন ভারতের আগরতলা রাজদরবারের সভাসঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের কন্যা বংশীয় নবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ।
মাত্র ১০ বছর বয়সেই সঙ্গীত শিক্ষার টানেই তিনি হন গৃহত্যাগী। এক গভীররাতে গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে দীর্ঘতর প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে নবীনগর উপজেলার মানিকনগর থেকে নদীপথে স্টিমারে চড়ে নারায়ণগঞ্জ চলে যান, অত:পর সেখান থেকে রেলযোগে পৌঁছান কলকাতায়। সেখানে বেশ কতেক মাস অবধি অনাহারে-অর্ধাহারে, ঘরের বারান্দায়-লাইটপোস্টের নীচে অতি নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাতের পর ওস্তাদ নুলো গোপালের সান্নিধ্য পান আলাউদ্দিন। তাঁর নিকট টানা সাত বছর তালিম নেন আলাউদ্দিন। এসময় ওস্তাদ গঙ্গারাম ঠাকুরের নিকটও পাল্টা অলংকার জাতীয় সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করেন।
–(এইচ.এম. সিরাজ)
ওস্তাদ নুলো গোপালের মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খাঁ ওস্তাদ হাবু দত্তের নিকট তালিম নেন বেহালা, ক্ল্যারিওনেটসহ অনেক বাদ্যযন্ত্রের। ওস্তাদ হাবু দত্তের নিকট থেকেই বাদ্যবৃন্দের সংযোজন এবং সঞ্চালনের বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। ইডেন গার্ডেনের ব্যাণ্ড মাস্টার লোবো সাহেবের নিকট পাশ্চাত্য সংগীতের শিক্ষা নেন এবং লোবো সাহেবের স্ত্রীর কাছে শিখেন পিয়ানো বাজানো। ওস্তাদ হাজারীর নিকট শিখেন সানাই ও নাকাড়া। এরপর ওস্তাদ আহমদ আলী খাঁর নিকট তিন বছর শিষ্য হিসেবে থেকে তালিম গ্রহণ করার পর রামপুরের নবাব হামিদ আলী খাঁর অনুকম্পায় তানসেনের বংশধর ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ওনার সংস্পর্শে থাকাকালীন সময়ে ব্যাণ্ড মাস্টার দুলী খাঁ, মহম্মদ হোসেন খাঁ, করিম খাঁ প্রমুখ বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের কাছ থেকেও শিখেন আরো অনেককিছুই।
ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর নিকট ২০ বছরের নির্ঘুম (সন্ধ্যে সাতটা থেকে ভোর পাঁচটা) সহ মোট ৩৩ বছর তালিম নেন আলাউদ্দিন খাঁ। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের মাইহার রাজ্যের রাজা ব্রজেন্দ্র সিংহ রায়ের গুরু হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সেখানে চলে যান। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ দুইশ’ রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সাথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে যান। দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্ররে সমন্বয়ে আর্কেষ্ট্রার স্টাইলে এক যন্ত্রীদল গঠন করে নাম দেন ‘রামপুর স্ট্রিং ব্যাণ্ড’। ব্রিটিশ সরকার আলাউদ্দিনকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র সৃষ্টিকৃত অসংখ্য  রাগরাগিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হেমন্ত-ভৈরব, হেমন্ত হেম বেহাগ, মদন-মঞ্জুরী, মাঝ-খাম্বাজ, গান্ধী, শুভাবতী, দুর্গেশ্বরী, প্রভাকরী, ধবলশ্রী, মাধবগিরি, ভুবনেশ্বরী, ভগবতী, মলুয়া-কল্যাণ, গান্ধী-বিলওয়াল, মুহম্মদ এবং মাধুরী। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য উপাধিগুলো হচ্ছে- ভারতকা গৌরব, আফতাব-এ-হিন্দু, সংগীতাচার্য (ভারতখণ্ড বিদ্যালয় ১৯৪৪ খ্রি.), সঙ্গীত নায়ক (মাইহার রাজা), দেশিকোত্তম (শান্তি নিকেতন ১৯৬৪ খ্রি.), সংগীত নাটক আকাদেমী পুরস্কার (১৯৫২ খ্রি.), আকাদেমী ফেলো (১৯৫৪ খ্রি.), পদ্ম বিভূষণ (১৯৫৮ ও ১৯৭১ খ্রি.), ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে এবং ঢাকা সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল তাঁকে প্রদান করে আজীবন সদস্যপদ । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁকে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করে।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষত্ব অর্জন করেন। নিজের সহজাত প্রতিভাগুণে তিনি সরোদ বাদনে তৈরি করেন নিজস্ব ধরণ এবং সেতারে সরোদের বাদন প্রণালি প্রয়োগ করে সেতার বাদনেও তিনি আনেন আমূল পরিবর্তন। এভাবেই তিনি সংগীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা ‘মাইহার ঘরানা’ নামে সুপরিচিত। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র পরামর্শ এবং নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রাম। আজও সেথায় রয়েছে বিশ্বখ্যাত এই সঙ্গীতজ্ঞের বসতভিটা। সুরের সাধকদের কাছে আলাউদ্দিনের এই বসতভিটা অনেকটা তীর্থস্থান। বসতভিটার পাশেই বিদ্যমান তাঁর নামে একটি কলেজ। এর পাশেই রয়েছে তাঁর নিজ হাতে গড়া সুদৃশ্য একটি মসজিদ। এটিকে ঘিরে জড়িয়ে আছে তাঁর অনেক স্মৃতিগাথা। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে তাঁর নির্মিত বাড়িতে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়। বর্তমানে সেটি ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’ নামে পরিচিত। এখানে এবং জন্মভিটা শিবপুরে আলাউদ্দিন মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার দাবী দীর্ঘদিনের। সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সকলকিছুই বহন করছে ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে।
বিশ্বখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কোনোদিন কোনো ছাত্রকে শিখানোর বিনিময়ে তার কাছ থেকে টাকা পয়সা নিতেন না। এমনকি গ্রহণ করতেন না কোন উপহার সামগ্রীও। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ আজকের দিনে ১১০ বছর বয়সে ভারতের মাইহার রাজ্যে ঘটে এই সাধক পুরুষের জীবনাবসান। ইহলোক ত্যাগ করেন, কিন্তু আজ অবধি বেঁচে আছেন তাবৎ বিশ্ববাসীর স্মরণে। আজকের দিনে খাঁ সাহেবকে বিনম্র শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, খোদার দরগায় কামনা করি ওনার আত্মার মাগফেরাত।
                                                        #
তথ্য সূত্র: (সংগৃহিত)
১. ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্বরচিত আত্মজীবনী। ২.ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ’র ‘পিতৃকথা’।
৩. অ্যাডভোকেট আহাম্মদ আলী’র ‘সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জীবন ও সাধনা’।
৪. মোবারক হোসেন খান’র ‘ওস্তাদ আলউদ্দিন খাঁ’।
৫. উইকিপিডিয়িা। ৬. বাংলাপিডিয়িা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : [email protected]
আরো পড়ুন