আমোদ শতায়ু-অতিক্রান্ত হোক

।। বায়তুল্লাহ্ কাদেরী ।।

একটি পত্রিকার সত্তর বছরে পদার্পণ নিঃসন্দেহে গৌরবের। এ যাত্রা বিসর্পিল, বন্ধুর ও জঙ্গমময়। সময়প্রবাহের বহু পললচিহ্ন পত্রিকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিজড়িত। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা ভাঙচুর এবং আবয়বিক রূপান্তরের সঙ্গে পত্রিকাটির অভিযোজন কত যে কষ্টসাধ্য সেটি কেবল অনুধাবন করতে সক্ষম পত্রিকাটির কুশীলববৃন্দ; যাঁরা এর সূচনালগ্ন থেকে শ্রম, ঘাম, আদর্শ এবং লক্ষ্যে অবিচল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেছেন। বলা বাহুল্য, পত্রিকাটি পুরনো জেলা শহর কুমিল্লার বহুল পরিচিত আমোদ। আমোদের সত্তর বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে কলম ধরতে গিয়ে আজ এর ঐতিহাসিক মূল্যটির কথাই বারবার সামনে চলে আসে। আমোদ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সুযোগ্য সন্তান বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং আলোকচিত্রী জনাব বাকীন রাব্বী সুদূর প্রবাস থেকে টেলিফোনে আমাকে বর্ষপূর্তির জন্য লেখার অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো আমোদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী বর্তমান লেখকের মানসগঠন পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
সময়টি ৮৩-৮৪ সাল। সবেমাত্র স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। মাথায় শুধু কবিতা লেখার চাপ। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও পাঠ্য পড়াশুনায় মন নেই। দেদারসে কলেজ-বিচ্যুতি ঘটিয়ে পড়ে থাকতাম ভিক্টোরিয়া কলেজের কোণায় পাবলিক লাইব্রেরি এবং কখনো কখনো বীরচন্দ্র পাঠাগারে। নানা বই-পত্রিকা এবং সাময়িকী চষে বেড়াচ্ছি। সেখানেই নিয়মিত পেয়ে যেতাম আমোদ। এর আগে দৈনিক রূপসী বাংলায় কবিতা ছাপাতে শুরু করি। রূপসী বাংলার সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওহাব নিজে একজন কবি। রাশভারি লোক; কিছুদিন কুমিল্লা কলেজে গিয়ে তাঁর ক্লাসেও বসেছি, একজন কবির সান্নিধ্যে পাবার আশায়। তিনি আমার কবিতাকে তাঁর কাগজে নিয়মিত প্রকাশ করতেন। কিন্তু তাঁর কাছে ঘেঁষতে সাহস হতো না। এর কাছাকাছি সময়ে আমোদেও আমার কবিতা ছাপা হতে লাগলো। আমার কাছে সময়গুলো মনে হতো শিহরণময়, আত্মমুগ্ধতার এবং ঘোরপ্রবণতার। আর এর থেকেই পড়াশুনা লাটে উঠতে থাকলো। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা আমার কাছে অসহ্য লাগা শুরু হলো; মনে হতে লাগলো কবিতা লেখার জন্য এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পড়া প্রবল অন্তরায়। মনে হলো রবীন্দ্রনাথ নজরুল এঁরা তো কেউ খুব প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করেননি। এর নিকট-দৃষ্টান্তও বিরল নয়। আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক এঁরা কেউ প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় মনোযোগী ছিলেন না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কলেজের পাঠ চুকিয়ে দেবো। বাড়িতে আমার অবস্থা দেখে আব্বা-আম্মা এবং ভাইবোন মহাচিন্তিত। ধীরে ধীরে বাতিলের তালিকায় তাঁরা আমাকে মাপতে শুরু করলেন। আমিও অনুধাবন করলাম বাবা-মার অন্ন ধ্বংস করা আমার উচিত হবে না। এ কারণে ভাবলাম, সাংবাদিকতা করা শুরু করবো। পত্রিকা অফিসে কাজ করবো। তাছাড়া আমার ভেতরে পত্রিকা এবং পত্রিকা-কেন্দ্রিক কাজ করার প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো। একদিন সকালেই গিয়ে হাজির হলাম আমোদ অফিসে। ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম, একটি বড় কক্ষ। এর দুটি ডেস্ক। বড় টেবিলটিতে বসে আছেন শামসুন্নাহার রাব্বী। অন্যটি এক কর্নারে একজন ভদ্রলোক নিবিষ্টচিত্তে নিউজপ্রিন্ট কাগজে কিছু লিখছেন। মনে পড়লো এই ভদ্রলোককে সম্ভবত আমি দৈনিক রূপসী বাংলা অফিসেও দেখেছি কোনো এক সন্ধ্যায়। আর পাশেই সোফায় বসে আছেন হাফহাতা গেঞ্জি-পরিহিত পুরোলেন্সের চশমাসহ একজন প্্েরৗঢ় ভদ্রলোক। যতদূর মনে পড়ে, সামনের দেয়ালে-সাঁটা সামরিক পোশাক পরা ভদ্রলোকের যৌবন বয়সের ছবি। আমি আমার পরিচয় দিতেই তিনি আমাকে চিনলেন এবং বসতে বললেন। জানালেন, আমি ভালো কবিতা লিখি। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি ফজলে রাব্বী। আমোদ সম্পাদক শামসুন্নাহার রাব্বীর সঙ্গে পরিচয় করালেন এবং সবশেষে কোনার ডেস্কের ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি বিশিষ্ট সাংবাদিক আবুল হাসানাত বাবুল। আমার কাছে জনাব রাব্বী সাহেবকে খুব কাছের মানুষ মনে হলো। মনে হলো এত শান্ত, সৌম্য, প্রাজ্ঞ এবং ধীশক্তির অধিকারী পুরুষের দেখা আমি জীবনে পাইনি। তিনি আমার পরিবারের পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি পরিচয় দিতেই জানালেন, তিনি আমার পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশদ অবগত। মনে হলো তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত হলেন। আমাকে লেখার অনুপ্রেরণা দিলেন। কিছুক্ষণ পরেই ভিতর থেকে একটি প্লেটে করে গরম খিচুড়ি এলো। বাবুল ভাইয়ের টেবিলে এবং আমার সামনে। এর ফাঁকে বাকীন রাব্বীর সঙ্গেও পরিচয় হলো। তিনি ভিতর থেকে একবার এলেন। বিস্তারিত জানলাম, পুরো পরিবারটিই মূলত আমোদের কুশীলব; এঁদের হাত ঘুরেই আমোদ পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। সেই অল্প বয়সে, অনভিজ্ঞ এক কিশোরের কাছে এ-বাড়ি এবং বাড়ির মানুষগুলোকে পৃথিবীর পরম আশ্চর্যের মতো মনে হলো। রাব্বী চাচা(পরে তাঁকে এ নামেই সম্বোধন করতাম) আমাকে তাঁর প্রেসঘর দেখালেন। লেটারপ্রেসের পায়ে-চাপ-দেয়া লাইনো টাইপের প্্রুফ নিয়ে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। ভাবলাম, কতই না সুন্দর এ জীবন; প্রেসঘরের কাগজের ভুরভুরে গন্ধে কতই না সাহিত্যের আমেজ-জড়ানো।
সেদিন আর নিজের অভিলাষের কথা জানাতে পারলাম না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ঘোর তৈরি হয়ে থাকলো। মনে হলো, আমি যদি ঐ কোণের টেবিলে-বসা ভ্রদ্রলোকটির(বাবুল ভাই) মতো এখানে একটা কাজের সুযোগ পেতাম! আরেকদিন খুব সকালে আমি রাব্বী চাচার ওখানে গিয়ে হাজির হলাম। তিনি আমার উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে বিস্মিত হলেন। আমি তাঁকে জানালাম। আমার বাড়িতে ঝামেলা হচ্ছে। আমি আর পড়াশুনা করতে চাই না। আমি পত্রিকায় কাজ করতে চাই। কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই। তিনি আমার সব কথা শুনলেন। আমাকে বোঝালেন, জীবন-জীবিকা এবং লেখালেখির জন্য প্রভূত জ্ঞান প্রয়োজন। বললেন, আমার পারিবারিক ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। আমার লেখাপড়া বন্ধ করা ঠিক হবে না। আরো বললেন, বরং তুমি যদি কাগজে সংবাদ পাঠাও আমি মানসম্মত হলে ছাপবো। তবে তোমার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে নয়। কাগজে কাজ করতে হলে অনেক সময় পড়ে আছে। তিনি তাঁর পূর্বের চাকরি এবং আমোদ প্রতিষ্ঠার ঘটনা আমাকে শোনালেন। মনে হলো, এমন স্নেহমাখা, অভিভাবকতুল্য পরামর্শ আমাকে আর কেউ দিতে পারতো না। তাঁর পরামর্শ আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে আমোদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হলো। বাবুল ভাই আমাকে তিননদী পরিষদের সদস্য করে নিলেন। দৈনিক রূপসী বাংলা, সাপ্তাহিক আমোদ আর তিননদী পরিষদ কুমিল্লার শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে আমাকে পরিচিত করে তুলল। তিননদী পরিষদ আয়োজিত আমার দুঃখের আঙুল নড়েচড়ে গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে ফজলে রাব্বী উপস্থিত ছিলেন। আলোচক ছিলেন আমোদ সম্পাদক শামসুন্নাহার রাব্বী। আলোকচিত্রী ছিলেন জনাব বাকীন রাব্বী। বাকীন ভাই পরে আমাকে সেই অনুষ্ঠানের কিছু ছবিও দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের সংবাদ ও ছবি ছাপা হয়েছিল আমোদের চলতি সংখ্যায়।
বলছিলাম, এ কারণেই আমোদের জন্য লেখা প্রদান আমার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আঞ্চলিক সংবাদপত্র হিসেবে আমোদ দীর্ঘদিন কুমিল্লার জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই পত্রিকাটি রাখা হতো। এর সাহিত্যপাতা ছিল সমৃদ্ধ। আমি বেগম পত্রিকার অনেক লেখকের লেখা এ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখেছি। এর সম্পাদকীয় নিবন্ধ ও প্রবন্ধগুলো সময়োপযোগী, সমাজ ও জনজীবনের প্রাত্যহিকতায় প্রভাববিস্তারী। একসময়ের কুমিল্লা-ব্্রাহ্মণবাড়িয়া-চাঁদপুর অঞ্চলের দীর্ঘ পরিসরে আমোদের বিচরণ ও ভূমিকা একটি সেতুবন্ধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেক পত্রিকার আবির্ভাবেও আমোদ অনুকরণীয় হয়েছিল, এ কথা বলাই যায়। পত্রিকটির প্রধান পুরুষ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর জীবন-প্রত্যয়ের সঙ্গে একীকৃত হয়েছিল এ পত্রিকার আবির্ভাব। একটি পুরো পরিবার একটি পত্রিকাকে ঘিরে সাংবাদিকতার চর্চায় নিয়োজিত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি আমার জানা নেই। আজ রাব্বী চাচা, চাচি লোকান্তরিত। তাঁদের স্বপ্নের সেই আমোদ সত্তরে পা দিতে চলেছে। বলা চলে আমোদকে আশ্রয় করে একদা আমার সাহিত্যযাত্রা শুরু হয়েছিল, আজো আমি সেই পথেই আছি। দেশে বিদেশে বহু পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হয়েছে। বাংলা কবিতা ও সাহিত্য গবেষণায় আমি ঋদ্ধ হয়েছি। কিন্তু আমোদে কবিতা ছাপার পর যে শিহরণ ও আনন্দ অনুভূত হয়েছিল কৈশোরে, সেই আনন্দ ও শিহরণ আমি আর কখনো পাই না। আমোদের সেই লেটারপ্রেসের পরম মমতাময়ী অক্ষরে আজো ধরা আছে আমার লেখক হবার আবেগ, কবি হবার উদ্ভ্রান্ত বাসনা। এ ক্ষেত্রে রাব্বী চাচার দ্বৈতসৃষ্টি আমোদ আর আমার সাহিত্যকীর্তি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জনাব মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী এবং তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী শামসুন্নাহার রাব্বীকে। আমোদ শতায়ু-অতিক্রান্ত হোক, জন্মদিনে এ ই প্রত্যাশা রইলো।

লেখক: অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।