আলোকচিত্র: একাল সেকাল

বাকীন রাব্বী।।
ফটোগ্রাফার বা ক্যামেরাম্যান শব্দ দুইটা আজকাল আর খুব একটা উচ্চারিত হয় না কোথাও। কারণ এখন সবাই ফটোগ্রাফার, সবাই ক্যামেরাম্যান। একটা সময় ছিল যখন কারো কাঁধে ক্যামেরা থাকলে তাঁর মর্যাদা ও গুরুত্ব বেড়ে যেত। কেউ তাঁকে ফটোগ্রাফার, কেউ ক্যামেরাম্যান বলে সম্বোধন করতেন।
ঐসময় ফটোগ্রাফাররা ক্যামেরায় ফিল্ম ঢুকিয়ে গুনে গুনে ছবি তুলতেন। ছবি তোলার সময় একটু পরপর দেখে নিতেন আর কয়টা ছবি এই ফ্লিমে তোলা যাবে। ফিল্ম ছিল দুই ধরনের। একটা ১২০ মিলি মিটার যা সাংবাদিকদের পাশাপাশি স্টুডিও মালিকরাও ব্যবহার করতেন। অপরটা ৩৫ এমএম, এটা অন্যসব ক্যামেরার জন্য। একটা ১২০ এমএম ফিল্ম দিয়ে ১২টা ছবি তোলা যেত। অপর দিকে ৩৫ এমএম ফিল্ম থেকে ৩৫ থেকে ৩৮টা ছবি হতো।
তখন ছবি তোলার সময় আলোর পর্যাপ্ততা দেখে ফটোগ্রাফার ক্যামেরার সার্টার স্পিড ও এ্যাপারচার পরিবর্তন করে নিতেন। প্রখর রোদের সময় তা হবে একরকম, হালকা রোদে অন্য রকম, আবার মেঘলা দিনে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে সার্টার স্পিড ও এ্যাপারচার।
গত শতাব্দির ৭০ ও ৮০’র দশকের কথা বলছি- তখন আমরা ১২০ এমএম ফিল্ম ব্যবহার করতাম আগফা, কোডাক অথবা ফর্টি। তিনটাই জার্মানির তৈরি, তবে আগফার চাহিদা বেশি ছিল। পরে একটি চাইনিজ দামে সস্তা ফিল্ম এসে বাজার দখল করে নেয়। ৮০’র দশকের মাঝামাঝিতে বাজারে এলো জাপানি ফুজি ও কনিকা ফিল্ম। কুমিল্লাতে ১৯৮৫ সালে ফুজি কোম্পানি তাদের নিজস্ব ল্যাব চালু করে। তখন থেকে কুমিল্লার ফটোগ্রাফাররা এবং স্টুডিওগুলি রঙিন ছবি তোলা শুরু করে। যদিও এটা ছিল খুবই ব্যয়বহুল। যাঁরা প্রেস ফটোগ্রাফি করতেন তাঁরা সাদাকালোকেই প্রাধান্য দিতেন, কারণ পত্রিকায় তখনও সাদাকালো ছবিই ছাপা হতো।
ভাবতে ভাল লাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আবদুস সাত্তার, হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের সব সরকার প্রধানদের ছবি তোলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁদের কিছু কিছু ঐতিহাসিক ছবি এখনো সংগ্রহে রেখেছি। সাদাকালো ফিল্ম ডেভেলপ ও ছবি প্রিন্ট করার জন্য আমার বাসাতেই ডার্করুম ছিল। নিজের তোলা ছবি নিজেই অন্ধকার কক্ষে বসে ডেভেলপ ও প্রিন্ট করতাম।
এ শতাব্দির শুরুতে এলো ফিল্ম বিহীন ডিজিটাল ক্যামেরা। এটা দিয়ে ছবি তোলার সময় আলোর তারতাম্য হলেও সার্টার স্পিড ও এ্যাপারচার পরিবর্তন করতে হতো না। স্বয়ংক্রিয় ভাবে ক্যামেরা তা নিয়ন্ত্রন করতো। ডিজিটাল ক্যামেরার অন্যতম সুবিধা ছিল এটাতে কোন প্রকার ফিল্ম প্রয়োজন হতো না বলে ফটোগ্রাফাররা যত খুশি ছবি তুলতে পারতেন।
আমার মত যাঁরা নিজে ছবি তুলে নিজেই তা প্রিন্ট করতেন, তাঁদের কাছে ফটোগ্রাফি জগতের এ আমুল পরিবর্তনটা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আজকাল সবাই পকেটে করেই ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যখন যেটা প্রয়োজন সাথে সাথে ক্যামেরাবান্দি করছেন। প্রয়োজন হয় না ফিল্ম কেনার, প্রয়োজন হয় না ফিল্ম ডেভেলপ প্রিন্ট করার। উপরন্ত ফিল্ম শেষ হওয়ার ভয়ে গুনে গুনে ছবি তুলতে হয় না।
ছবি তোলা এখন এত সহজ হলেও ফটোগ্রাফির বিষয়, এ্যাঙ্গেল ও ফ্রেমিং কিন্তু ক্যামেরা বলে দেয় না। এটা আসতে হবে ফটোগ্রফারের নিজস্ব মেধা ও মনন থেকে। এ জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণের।
লেখক পরিচিতি: স্বাধীনতা উত্তর কুমিল্লার প্রথম প্রেস ফটোগ্রাফার। ফ্রান্স থেকে প্রেস ফটোগ্রাফির উপর উচ্চতর ডিগ্রিধারী।