কবিতার ডানায় ছুটে চলা জীবন

মনোয়ার হোসেন রতন।।
মানুষ জন্ম থেকেই এক চলমান প্রাণী। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অন্তহীন যাত্রার ছায়াপথ, যার কোনো নিশ্চিত গন্তব্য নেই। সময়ের প্রেরণা, স্বপ্নের আহ্বান, সংগ্রামের আগুন কিংবা প্রেমের আকুলতা—সব মিলিয়েই জীবনের ছুটে চলা। এই চলমানতা শুধু বাস্তবতায় নয়, গভীরভাবে ধরা পড়ে কবিতার ভাষায়, কবির চিন্তায়।
কবিতা কেবল শব্দের বিন্যাস নয়—এ এক জীবনের বহতা নদী, যেখানে ‘গতি’ কখনো রূপ নেয় বিদ্রোহে, কখনো প্রেমে, কখনো আত্মোপলব্ধিতে। এই গতিই আমাদের জীবনের অন্তরস্বর।
সময় চলে, মানুষ চলে, কবিতাও চলে
সময় থেমে থাকে না—এ বাস্তবতা কবিদের অনুভবে গভীর ছায়া ফেলেছে। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন
“সময় প্রতিদিন পালায়,
আমার হাতে ধরা দেয় না,
আমি শুধু শুনি তার গতি।”
এই পঙ্ক্তিতে জীবনের অস্থিরতা যেন ছায়ার মতো লেপ্টে থাকে। জীবনানন্দ দাশ তো আরও একধাপ এগিয়ে বলেন—
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…”
এ যেন চিরন্তন এক গমনযাত্রার রূপক, যেখানে গন্তব্য নয়, বরং চলাই মুখ্য।
নজরুল: গতি মানেই বিদ্রোহ
বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম—যিনি গতিকে রূপ দিয়েছেন বিদ্রোহের বজ্রনিনাদে। তাঁর “চল চল চল” কবিতায় উচ্চারণ করেছেন—
“চল চল চল
উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল—
নিচে প্রলয় নৃত্য-তাল।”
এখানে গতি মানে পুরনো শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি ছুটে চলে অদম্য গতিতে—এক মুক্ত আত্মার জয়ধ্বনি হয়ে।
রবীন্দ্রনাথ: অন্তর্জগতের নিঃশব্দ গতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় গতি এক ধ্যানমগ্ন অভিপ্রায়। তাঁর ‘একলা চলো রে’ গানটি যেমন আত্মনির্ভরতার প্রতীক, তেমনি এক অন্তর্জাগতিক চলার বার্তা—
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।”
এই চলা বাহ্যিক গন্তব্যের দিকে নয়—বরং আত্মগঠনের পথে যাত্রা।
প্রেম, বিচ্ছেদ আর গতির ছায়া জীবনে প্রেম যেমন আসে, আসে বিচ্ছেদও। সেই আবেগের ভেতরেও গতি লুকিয়ে থাকে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হৃদয়গ্রাহী কবিতায় উচ্চারিত হয়—
‘আমার ভিতরে উড়ে যায় অসংখ্য পাখি,
তারা ফিরেও আসে না।”
এই উড়ে যাওয়া মানেই অন্তর্জগতের চলমানতা। হেলাল হাফিজ লিখেছেন—
“যে জীবনে প্রেম নেই
সে জীবন গতি নেই
সে জীবন পচনশীল।”
প্রেমহীন জীবন যেন স্থবির আর নিষ্প্রাণ।
সংগ্রাম ও পথের গতি
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ—যিনি নিজেকে দেখেছেন পথের ফেরিওয়ালা হিসেবে, বলেন—
“আমি ক্লান্ত, আমি তবু পথ ছাড়ি না—
আমি কবি, আমি পথের ফেরিওয়ালা।’
এটি শুধু কবির একান্ত অনুভব নয়—প্রতিটি সংগ্রামী জীবনের মর্মবাণী।
বিশ্বকবিতার দৃষ্টিতে গতি
বিশ্বকবিতাতেও জীবনের গতি ধরা পড়ে অসাধারণভাবে। আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান বলেন—
“I tramp a perpetual journey.”
চিরন্তন এই যাত্রা আধুনিক মানুষের অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে। চিলির কবি পাবলো নেরুদা বলেন—
‘You can cut all the flowers but you cannot keep spring from coming.”
জীবনের চলার ধারা কখনো রুদ্ধ হয় না। বসন্ত ঠিকই ফিরে আসে। গতি মানেই জীবন, গতি মানেই কবিতা। মানুষের জীবনে গতি আসে—প্রেমে, স্বপ্নে, বিপ্লবে, শূন্যতায়। কবিতা সেই গতি ছুঁয়ে দেখে—চোখের জলে, বিপ্লবের চিৎকারে, কিংবা একাকী প্রভাতের আলোয়। কবিরা আমাদের শেখান—জীবন মানেই চলা, চলা মানেই বেঁচে থাকা।
যতদিন আমরা চলতে পারি, ততদিনই আমরা বেঁচে থাকি। কবিতাই সেই চলার প্রেরণা, আত্মার সহযাত্রী।
“হে গতি, হে ছুটে চলা,
তুমি আমার হৃদয় খুলে দাও—
আমি হয়ে যাই চলমান কবিতা।’
