কোরবানির আমল ও ফজিলত  

 

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
ইসলামে যত বিধান আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কোরবানি। কোরবানি করা অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। এততে আছে আত্নত্যাগের মহিমা মানবসেবার গৌরব। আদি পিতা হযরত আদম( আঃ) – এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল থেকে শুরু হওয়া এই কোরবানির ইতিহাস মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম( আঃ) ও তাঁর শিশু পুত্র হযরত ইসমাইল ( আঃ) – এর মহান আত্নবিসর্জনে উজ্জ্বল, যা কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। 

 

স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন,  প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম যদি ‘ নিসাব’ পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তাকে কোরবানি  করা ওয়াজিব। নিসাব হল সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা বা সম্পদ। কোরবানি মানে কাছে যাওয়া বা নৈকট্য অর্জন করা, ত্যাগ স্বীকার করা বা বিসর্জন দেওয়া। যা জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুসারে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। 

 

কোরবানির মাংস ধনী- গরীব সবাই খেতে পারেন। সুন্নাত হল কিছু অংশ আত্নীয়স্বজনকে দেওয়া, কিছু অংশ গরীব পাড়া- প্রতিবেশীদের দেওয়া এবং কিছু নিজের পরিবারের  জন্য রাখা। যত বেশি দেবে, তত ভালো। প্রয়োজনে পুরোটা রাখা যাবে। অনেকে সাত ভাগের এক ভাগ দিয়ে থাকেন, অনেকে সামান্য রেখে পুরোটাই দিয়ে দেন। ত্যাগের কোরবানির মাংস ভোগের জন্য  রাখা অনৈতিক ও  অমানবিক। তবে, বিশেষ কোন কারণে রাখলে দোষের কিছু নেই। 
       মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ” আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, তিনি তাদের জীবিকাস্বরুপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে ( কোরবানি) করে। “( সূরা হজঃ৩৪)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোরবানির দিনে মহান আল্লাহর নিকট রক্ত ঝরানোর চেয়ে প্রিয় কোন কিছু নেই। এটি কিয়ামতের দিন তার শিং, লোম ও ক্ষুর নিয়ে উপস্থিত হবে। পশুটি জবাই করার সময় প্রথম যে রক্তের ফোঁটা পড়ে, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছার পূর্বেই কোরবানি আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং একান্ত ভক্তি ও আগ্রহের সাথে খুব ভালো পশু দেখে কোরবানি করবে। ( তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবিগণ জিঞ্জাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কি?  রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন,  এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহিম ( আঃ) এর সুন্নাত আদর্শ।  হযরত সাহাবায়ে কেরামগণ বললেন,  এতে আমাদের কি আছে?  রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন, কোরবানিকৃত পশুর যত পশম থাকে, প্রত্যেক পশমের পরির্বতে এক একটি নেকী লেখা হয়। ( আহমাদ ও ইবনে মাজাহ) । ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ্ব কোরবানি করতে হয়।  উট পাঁচ বছর, গরু ও মহিষ দুই বছর, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা এক বছরের হলে কোরবানি করা যায়। 
কোরবানির শাব্দিক অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভ।  মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হওয়া। আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া। আর এ সব লাভ করতে হয় ত্যাগের বিনিময়ে। ভোগে সুখ  থাকলেও প্রকৃত সুখ, আনন্দ ও শান্তি কিন্তু ত্যাগেই বিদ্যমান। কোরবানি মূলত হযরত ইব্রাহিম ( আঃ) এর স্মৃতিস্মারক। যার পুরো জীবনটাই ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত।  মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। তাই সত্য প্রকাশে সাহস দেখাতে কুন্ঠিত হননি তিনি। আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদ ঘোষণার কারণে রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়েন, এমনকি পিতার বিরাগভাজনও হতে হয় তাকে। 
ইরাকের অধিবাসী হযরত ইব্রাহীম ( আঃ) জম্মভূমি ত্যাগ করে ফিলিস্তিন, মিসর এবং সৌদি আরব পর্যন্ত তার মিশনারি দাওয়াত প্রসারিত করেন। আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার জন্য বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া ছেলে ইসমাইল( আঃ) ও বি্ব হাজেরাকে প্রভুর ইশারায় বিজন মরুভূমি আজকের মক্কা অঞ্চলে রেখে আসেন। এটা কত বড় কোরবানি প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনে ( একটু গভীর ভাবে ভাবা)  প্রয়োজন। মক্কা মুয়াজজ্জমা আবাদ, বায়তুল্লাহ প্রতিষ্ঠা, আবে জমজম  ও সাফা- মারওয়াহ পাহাড়দ্বয়  তাঁরই স্মৃতিবাহক। 
হযরত ইব্রাহিম ( আঃ) কে বৃদ্ধ বয়সে মহান আল্লাহ তায়ালা চরম পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করালেন। পুত্র ইসমাইল কে জবেহ কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। পিতা পুত্রকে বললেন, বাবা! কি মনে কর বা বল?   পুত্র খুশির সঙ্গে বললেন, আল্লাহর হুকুম পালন করুন। আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। পিতা ছুড়ি চালাতে তৈরি। সে কি করুণ মুহুর্ত! এদিকে হযরত ইব্রাহিম ( আঃ)এর কোরবানি মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে গেল। মহান আল্লাহর ঘোষণা ” হে ইব্রাহীম!  তোমার পুত্র   কোরবানি   হয়ে গেছে। আমি একটি পশু কোরবানি করিয়ে পুত্র কোরবানির স্থলাভিষিক্ত করে দিলাম। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত এ পশু কোরবানি চলতেই থাকবে। এর স্মরণে, যে পশু কোরবানি করবে, সে যেন আল্লাহর নামে পুত্র কোরবানি করল।হযরত ইব্রাহিম ( আঃ) শুধু  পুত্র কোরবানির পরীক্ষায়ই দেননি, তিনি নমরুদ কর্তৃক আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হল। কিন্তু হযরত  ইব্রাহিম( আঃ)  শান্তির ধর্ম, মুক্তির ধর্ম তথা  আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দাওয়াত থেকে বিরত হয়নি। তখন নমরুদ তাকে আগুনের কুন্ডলীর মধ্যে নিক্ষেপ করে। কিন্তু আগুন তাকে স্পর্শও করেনি বরংআল্লাহ তায়ালার নির্দেশে আগুন ঠান্ডা ও শান্ত ছিল; সুবহানাল্লাহ। আগুন হযরত ইব্রাহিম( আঃ) এর কাছেও ঘেঁষেনি। তিনি নিরাপদে বেরিয়ে এলেন। 
আমাদের উচিত হযরত ইব্রাহিম( আঃ) এর আদর্শ- ত্যাগ  জানা- বোঝার পাশাপাশি কোরআন- সুন্নাহ জ্ঞানার্জন করা। 
হযরত মূসা ( আঃ) এর যুগে ফেরাউনের নাম কোরআন তথা মানব ইতিহাসে সমধিক আলোচিত হয়েছে। কোরবানির মর্মকথা ও শিক্ষা যদি আমরা  বুঝতে না পারি ; তা হলে গোশত খাওয়াই হবে সার। কারণ  পশুর গোশত ও রক্ত কখনোই আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ( আল্লাহ ভীতি ও প্রেমজনিত ভাবধারার) চিন্তা ওচেতনার সাথে জীবন গড়ার জন্য পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন আল্লাহ। তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে পশুগুলোকে ব্যবহার করবে। আর এরুপ নেক বান্দাদের হে নবী!  আপনি সুসংবাদ দান করুন। ( সূরা হজ্বঃ ৩৭)      
একটি আমলের কথাঃ জিলহজ্জ  মাসের চাঁদ ওঠার পর চুল, গোঁফ, নখ, বগল ও অন্যান্য স্থানের লোম বা পশম না কাটা। উম্মে সালমা ( রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে এবং কোরবানির নিয়ত বা ইচ্ছা করে, সে যতক্ষণ কোরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে। অন্য আরেকটি আমল, জিলহজের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে  ১৩ তারিখের আসরের নামাজ পর্যন্ত অর্থাৎ মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পাঠ।  তাকবিরে তাশরিক হল, ” আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু  ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ “। প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর অন্তত এক থেকে তিনবার  পাঠ করা কর্তব্য।  
আরো একটি কথাঃ যদি কেউ কোরবানির পশু কেনা, জবাই করা  ও মাংস বিতরণ করা ঝামেলা মনে করেন বা এড়াতে চান, তবে বিশ্বস্ত কোন ব্যক্তি, আত্নীয়স্বজন বা গ্রামের মানুষ বা নির্ভরযোগ্য কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সেবা সংস্থাকে কোরবানি সম্পাদনের দায়িত্ব দিতে পারেন, দেওয়া যায়।   হে আল্লাহ!  আপনি আমাদের সকলকে জিলহজ মাসের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমাদের সব ইবাদত কবুল করুন।
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট, বুড়িচং- কুমিল্লা। 
প্রকাশনা সম্পাদকঃ বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, কুমিল্লা জেলা কমিটি এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা কবি ফোরাম।