দেড়’শ বছরের ইতিহাসে হাতুড়ির আঘাত!

কুমিল্লা নবাব বাড়ি

ইলিয়াছ হোসাইন।।
কুমিল্লা নবাব বাড়ি। প্রায় দেড়’শ বছরের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য বহন করছে। এটি কুমিল্লা নগরীর উত্তর চর্থায় অবস্থিত। স্থাপনার মূল ফটকের কারুকার্য এবং নকশা নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের। পাখির কিচিরমিচির আর কৃষ্ণচূড়া,রাধাচূড়াসহ বহু রঙের ফুলে সুশোভিত আঙ্গিনা। প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী এখানে ঘুরতে আসেন। বাড়ির নাম অনুসারে জায়গাটি নবাব বাড়ি চৌমুহনী নামে পরিচিত। ভাঙ্গা হচ্ছে এর সামনের একাংশ। কুমিল্লার এ অন্যতম স্থাপনাটির পর্যটন স্থান হিসেবে সরকারিভাবে কোনো স্বীকৃতি মিলেনি। অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে বাড়ির মূল ভবনটিও।
সরেজমেনি দেখা যায়, নবাব বাড়ির উত্তর অংশের দেড়শত বছরের প্রাচীন একতলা বিশিষ্ট ভবনটি ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
সূত্রমতে,১৮৭৮সনে সৈয়দ বশরত উল্লাহ কসবা থেকে এসে এখানে বাড়িটি প্রথম নির্মাণ করেন। তার নানার বাড়ি লাকসাম পশ্চিমগাঁও। তার ছেলে হোচ্ছাম হায়দার। তিনি ১৯০৮ সনে নবাব উপাধিতে ভূষিত হোন। তার হাত ধরেই বাড়িটির নির্মাণশৈলী তৈরি হয়। সাড়ে চার একর জমির উপর নির্মিত বাড়িটির ৪০শতাংশ জায়গায় রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান, মক্তব। মক্তবটি বর্তমানে সুবিধাবঞ্চিত এতিম শিশুদের হাফেজি মাদ্রাসা এবং মসজিদ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। মূল ভবনটি দু’তলা বিশিষ্ট। নীচ তলা এবং উপর তলা মিলিয়ে প্রায় নয় হাজার ছয়’শ স্কয়ারফিটের বাড়ি। নীচ তলায় ৮টি কক্ষ,উপর তলায় ১০ টি কক্ষ রয়েছে। দু’টি ফ্লোরে ৬০টি দরজা এবং ৪৮টি জানালা রয়েছে। নবাবের আমন্ত্রণে এ বাড়িতে পা রেখেছেন বিশ্বকবি রবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নবাবের সাথে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। বর্তমানে নবাবের ৪৬জন উত্তরসূরী জীবিত আছেন।
ষাটোর্ধ্ব স্থানীয় রুহুল আমীন বলেন,ছোট বেলা থেকে বাড়িটি দেইখা আসতাছি। আগে যেমন ছিলো অহনকালাও তেমনই আছে। দূর-দূরান্ত থাইকা অনেক মানুষ দেখতো আসে। বাড়িডা সুন্দর এবং ব্যতিক্রম। অনেকে ছবিও তুইলা নিয়া যায়। বাড়িডা যদি সরকার দেখবাল করতো তাহলে এখানকার পরিবেশ আরো সুন্দর হইতো,ভালা হইতো। পর্যটন স্থান হিসাবেও গড়ে উঠতো।আর আমরা যদ্দূর শুনছি যে অংশডা ভাইঙালাইছে সেডা কয়মাস ধইরা ভাইঙা ভাইঙা পড়তাছে। তারা(বাড়ির মালিক) ইঞ্জিনিয়ার আনছে। পরামর্শ দিছে এডা থাকবোনা,ভাইঙ্গা পড়বো। আবার নিজেও নিজেও এডা ভাইঙ্গা পড়তাছিলো। এইহানে মানুষ থাকতো,তাগোরে সরাইয়া নিছে। তারপর তারা এডা ভাঙ্গতাছে আরকি। বাড়ির চারদিকে বিক্রির সাইনবোর্ডও ঝুলাইয়া রাখছে।


মসজিদে দায়িত্বরত হাফেজ মাওলানা ক্বারী আব্দুল হান্নান নূরী বলেন,নবাব বাড়ির পশ্চিম দিকের অংশে রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান। এখানে নবাব হোচ্ছাম হায়দারসহ তার উত্তরসূরীদের কবর রয়েছে। কবরগুলোর বয়স একশত পঞ্চাশ বছর প্রায়।তারপাশেই রয়েছে সে আমলে নির্মিত প্রাচীন মসজিদ। এখানে আশেপাশের মানুষ পাঞ্জেগানা নামাজ পড়তেন। নবাবদের সন্তানরা এখান থেকে কোরআন শিখতো, নামাজের নিয়মকানুন শিখতো। বর্তমান উত্তরসূরীরাও তার পূর্বপুরুষদের স্মরণে এটাকে চালু রেখেছেন;আশেপাশের এতিম এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য হাফেজি মাদ্রাসা হিসেবে সংস্কার করে দিয়েছেন। এছাড়াও কুমিল্লা সদর হসপিটাল,হোচ্ছামিয়া স্কুল,ইউসূফ হাই স্কুল,লুৎফুন্নেছা স্কুলসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নবাবরা করেছেন। আসলে নবাব পরিবার ইসলামের জন্য এবং জনকল্যাণে অনেক কাজ করেছেন। আমি এ মসজিদের হেফাজতের দায়িত্বে প্রায় সাত বছর আছি।

 

আলোকিত বজ্রপুরের সংগঠক মো.রফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন,নবাববাড়ি হচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপনা। এ নবাব বাড়ির সাথে সম্পর্ক রয়েছে উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী শচীনদেব বর্মণের। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নবাব বাড়ি ভাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে! এর অর্থ হচ্ছে এ বাড়ির যারা আছে তাদের এ স্থাপনার প্রতি অনুভূতি কমে গেছে। অথবা তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আমি প্রত্যাশা করি আমাদের কুমিল্লার প্রশাসন এ ব্যাপারে নজর দিবেন। আমাদের নব নির্বাচিত তরুণ মেয়র নগর কন্যা তাহসিন বাহার সূচনাও এ বাড়ির মালিক পক্ষদের সাথে বসে বাড়িটিকে আগামীর প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত করে একটা মিউজিয়াম হিসেবে রুপ দেবেন বলে আশা করি। যাতে আগামীর প্রজন্ম বুঝতে পারে আমাদের কুমিল্লার ইতিহাস,ঐতিহ্য কতোটা সমৃদ্ধ ।
লেখক,গবেষক,ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন,কুমিল্লার নবাব বাড়ি শুধু কুমিল্লারই নয়,এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক বাহক। এটি আমাদের বর্ণাঢ্য অতীত। আমাদের যে সমৃদ্ধ তার প্রতীক এটি। আদি কুমিল্লার উন্নয়নের জন্য নবাব হোচ্ছাম হায়দারের অবদান অতুলনীয়। তিনি এখানে কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমান কুমিল্লা মহিলা কলেজ,শেরেবাংলা হোস্টেল নবাবের জায়গার উপরেই প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এ পরিবারের ইতিহাস কুমিল্লার ইতিহাসের সাথে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঐতিহাসিক এ বাড়িটি ভেঙে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে একাংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়িটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। তারপরেও বলবো আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনের কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে বাড়িটির মূলভবনটিকে সংরক্ষণ করা সময়ের দাবি।