নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
।। রাশেদা আক্তার।।
নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন প্রথিতযশা সমাজসেবী। সমাজ সেবার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন শিক্ষা বিস্তারে। বিশেষ করে নারী শিক্ষা বিস্তারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমান সমাজ যখন পর্চাদপদতার অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন এই অসীম সাহসী নারী শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদান রেখে সমাজকে আলোকিত করার প্রয়াস চালান।
জমিদার কন্যা ফয়জুন্নেছা গৃহশিক্ষকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অন্তরের প্রেরণায় হয়েছেন শিক্ষানুরাগী। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শিক্ষাই পারে জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে, আত্মমর্যাদায় বলীয়ান করতে। তাই পারিবারিক এবতেদায়ী মাদ্রাসাকে নিজ উদ্যোগে হাই মাদ্রাসায় উন্নীত করেন, যা পরবর্তীতে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে রূপ লাভ করে।
তাঁর অমর কীর্তি কুমিল্লার বুকে ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত শুধুমাত্র বালিকাদের জন্য ফয়জুন্নেছা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়, যা বর্তমানে নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে খ্যাত। প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করেছেন। একান্তই নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের বাসভবনসহ ছাত্রীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ছাত্রী নিবাস। মুসলমান মেয়েদের শিক্ষায় আগ্রহী করার জন্য জমিদারীর আয় থেকে তাদের মাসিক বৃত্তিরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া নানুয়াদিঘির পশ্চিম পাড়ে আরও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ইনকাম ট্যাক্সের জনৈক উকিল সাহেব অল্প টাকার বিনিময়ে অধিগ্রহণ করে নিজ স্ত্রী শৈলরাণী দেবীর নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শৈলরাণী পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’।
তিনি হোমনাবাদ পরগণার প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। নিজ জমিদারীর চৌদ্দটি মৌজার প্রতিটিতে স্থাপন করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়। লাকসামের পশ্চিমগাঁয়ে আরো একটি বিদ্যালয় তিনি এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা বদরুন্নেছা যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। নাম রাখেন নবাব ফয়জুন্নেছা ও বদরুন্নেছা যুক্ত উচ্চ বিদ্যালয় তথা এফ এন এন্ড বি এন হাই স্কুল। এমনকি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরেও তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে ঐতিহাসিক তথ্যমতে জানা যায়।
নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করতে পরিবারসহ ১৮৯৪ সালে মক্কায় গমন করেন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে বছর হজ্জ্ব পালনে অপারগ হয়ে ১টি বছর সেখানেই অবস্থান করেন। এই সময়ে তিনি মক্কায় মেসফালা নামক স্থানে মাদ্রাসা ও মুসাফিরখানা স্থাপন করেন। এছাড়া মক্কায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাই সাওলাতিয়ায় ও মাদ্রাসাই ফুরকানিয়ায় সাহায্য ও অন্যান্য সৎকর্মের জন্য বাৎসরিক ৩০০ টাকা করে অনুদান প্রদান করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তাঁর উত্তরাধিকারীগণও দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই অনুদানের অর্থ প্রেরণ করে গেছেন। এছাড়া হজ্জ্ব যাত্রীদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য তিনি ‘নাহরে যোবাইদা’ খাল পুন:খনন করেন।
শিক্ষাব্রতী নবাব ফয়জুন্নেছা শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সেবায় নিজের দ্বিতল বসতবাড়িটিসহ বিশাল জমিদারীর আয়ের ৬০ শতাংশ রাহেলিল্লাহ ওয়াক্ফ করে মানব সেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এই মহীয়সী নারী পরলোক গমন করেন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক:প্রধান শিক্ষক.নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুমিল্লা।