বাংলাদেশের রাজনীতি ও চতুর কৌশলের খেলা

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক জটিল, প্রতারণামূলক ও চতুর কৌশলের খেলায় পরিণত হয়েছে। কথায় আছে—পাখির ডাকেই বোঝা যায় সকালটা কেমন যাবে। কিন্তু যখন চারপাশে শুধু কাকের কর্কশ ডাক কিংবা কোকিলের ছলনাময় সুর শোনা যায়, তখন ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না।
এই বাস্তবতাকে প্রতীকীভাবে বোঝাতে কাক ও কোকিল—এই দুই পাখিকে সামনে এনে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি। কাক যেমন হিংস্র, দলবদ্ধ, সুযোগসন্ধানী ও চতুর; ঠিক তেমনি কিছু রাজনীতিকও এখন হিংস্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, শুধুমাত্র ক্ষমতা ও নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য। তারা নিজের দলের স্বার্থে অন্যকে টেনে নামাতে দ্বিধা করে না, ঠিক যেমন কাক খাদ্যের জন্য দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, কোকিলের মধুর কণ্ঠস্বর আমাদের প্রথমে মুগ্ধ করে। কিন্তু সে যে অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে, তা আমরা অনেকে জানলেও অবহেলা করি। এভাবেই কিছু রাজনীতিক জনগণের ভালোবাসা কুড়াতে মধুর ভাষণ দেন, স্লোগান দেন, প্রতিশ্রুতি দেন—কিন্তু বাস্তবে তারা অন্যের অর্জনে ভাগ বসান এবং নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন।
“They promise to build bridges even where there are no rivers.”
— Nikita Khrushchev
(তারা এমন জায়গাতেও সেতু বানানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, যেখানে কোনো নদীই নেই।)
এ ধরনের প্রতিশ্রুতি শুধু রাজনৈতিক হাস্যরস নয়, এটা জনগণের সঙ্গে এক প্রকার প্রতারণা। উন্নয়নের বুলি ছুড়ে দিয়ে আত্মস্বার্থে লিপ্ত হয়ে পড়া নেতাদের এই চেহারা নতুন কিছু নয়, বরং দিনে দিনে তা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
“A statesman is a politician who’s been dead for ten years.”
— Harry S. Truman
(একজন রাষ্ট্রনায়ক সেই রাজনীতিবিদ, যিনি মারা গেছেন দশ বছর আগে।)
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আমাদের সমাজে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক একপ্রকার বিলুপ্ত। রাজনীতিতে নীতি ও জনসেবার জায়গায় এসেছে জনপ্রিয়তা ও মিডিয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে জনমোহিনী চেহারা তৈরি করা। এখনকার অনেক নেতা শুধুমাত্র জনদরদী ভাবমূর্তি গড়ে তোলার মধ্যেই নিজেদের সফল ভাবেন।
“Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely.”
— Lord Acton
(ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে, আর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিগ্রস্ত করে।)
কাক-কোকিলের যুগল প্রতীকের মধ্যে একদিকে রাজনৈতিক চাতুর্য, অন্যদিকে আদর্শহীন মাধুর্যের মোহ প্রতিফলিত হয়। তারা বাহ্যিকভাবে একে অপরের প্রতিপক্ষ হলেও মূলত একই মানসিকতা ও বৃত্তে আবদ্ধ—ক্ষমতার লিপ্সা, নৈতিকতার অভাব এবং জনবিচ্ছিন্নতা তাদের একসূত্রে গাঁথা করে রেখেছে।
“If we desire respect for the law, we must first make the law respectable.”
— Louis D. Brandeis
(আমরা যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পেতে চাই, তবে প্রথমে আইনের যোগ্যতা তৈরি করতে হবে।)
আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো—নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব। এমন নেতৃত্ব যারা কাকের কর্কশতা নয়, কোকিলের ছলনা নয়—বরং জনগণের প্রকৃত প্রয়োজনে সাড়া দেবে। যারা প্রতিশ্রুতিকে প্রচারণার হাতিয়ার নয়, দায়িত্বের বন্ধনে রূপ দিতে জানবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে পুনরায় নৈতিকতা, স্বচ্ছতা এবং মানবিকতার পথে ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কাক-কোকিলের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়কের উজ্জ্বল মুখ ফিরে পাওয়ার সময় এখনই।
