বাঞ্ছারামপুরে বিলে বাঁধ : ক্ষতিগ্রস্থ সহস্রাধিক কৃষক

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
 ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় অনাবাদী হয়ে আছে প্রায় তিনশ’ হেক্টর কৃষি জমি। এসব জমি থেকে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক ধান উৎপাদন হবার কথা জানান কৃষি বিভাগ। স্থানীয় বাড়িয়াহ বিলে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের কারণে কচুরিপানা আটকে প্রায় চার হাজার কৃষকের জমি হয়ে পড়েছে চাষের অনুপযোগী হয়ে। এছাড়া বিলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নৌযান চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও মিলছে না কোনোই প্রতিকার।
স্থানীয় উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন সুজন বলেন, প্রতি হেক্টর জমিতে ছয় মেট্রিক টনেরও বেশি ধান উৎপাদন হয়। সেই হিসেবে বিলে বাঁধ দেওয়ার কারণে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়া তিনশ’ হেক্টর জমিতে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। মাছ চাষের জন্য অবৈধভাবে দেয়া বাঁধের কারণে জমিতে কচুরিপানা আটকে কৃষকের ধানি জমি যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বিলে পানির প্রবাহও হচ্ছে ব্যাহত। এই জমির ওপর চার হাজার কৃষক পরিবারের জীবিকা নির্ভর করে। সেজন্য দ্রুত বাঁধটি অপসারণ করে জমিগুলোকে চাষের উপযোগী করে তোলা প্রয়োজন।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদ ও রূপসদী ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে থাকা বাড়িয়াদহ বিলটি স্থানীয় ফরদাবাদ-রূপসদী ধীবর সমবায় সমিতির নামে তিন বছরের জন্য ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। সমিতির সদস্য পিছন দাসের নামে ইজারা নেয়া হলেও শর্ত লঙ্ঘন করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে দেয় সাব ইজারা। ওই সাব ইজারাদাররা মাছ চাষের জন্য বাঁশ ও জাল দিয়ে বাঁধ দেন। আর এই বাঁধের কারণে কচুরিপানা আটকে কৃষকদের প্রায় তিনশ’ হেক্টর ফসলি জমি অনাবাদী হয়ে পড়েছে বলে কৃষকদের অভিযোগ। মাছ চাষের জন্য অবৈধভাবে বিলের প্রায় চার  কিলোমিটার অংশজুড়ে বাঁশ ও জাল দিয়ে বাঁধ দিয়েছেন সাব ইজারাদাররা। বাঁধের ভেতরেই করা হচ্ছে মাছ চাষ। বাঁশ-জালের বাঁধ এলাকার মধ্যেও অনেক কৃষকের জমি রয়েছে। এছাড়া বাঁধের কারণে বিলের আশপাশের প্রায় তিনশ হেক্টর জমিতে কচুরিপানা ভরে গেছে। এতে করে কৃষকরা তাদের জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না। বাঁধ দেয়ার আগে বিলে বিভিন্ন নৌযান চললেও এখন আর কোনো নৌযাচান চলাচল করতে পারছে না। আর সরকারের ‘জাল যার, জলা তার’ নীতিও হচ্ছর ব্যাহত।
ক্ষতিগ্রস্ত আবদুল জলিল জানিয়েছেন, ‘এক কাণি জমি (৩০ শতাংশ) থেকে কচুরিপানা সরাতে প্রায় ৫/৭ হাজার টাকা খরচ লাগে। কিন্তু এই টাকা টাকা খরচ করে অধিকাংশ কৃষকেরই কচুরিপানা সরানোর সক্ষমতা নেই। নিজের জমিতে চাষাবাদ না করতে পারা কৃষকরা বিলে মাছ ধরতে গেলে ইজারাদাররা বাঁধা প্রদান করে থাকেন। রূপসদী গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সাত্তার মিয়া জানান, বাড়িয়াদহ বিলের পাশে আমার আড়াই কাণি কৃষি জমি রয়েছে। প্রতি মৌসুমে এই জমি থেকে প্রায় ৫০ মণের মতো ধান গোলায় তুলি। কিন্তু বিলে বাঁধ দেয়ার কারণে সব জমি এখন কচুরিপানার নিচে। আর তাই মওসুমে ধান চাষ করতে পারিনি। এবারের মৌসুমেও  চাষ করা হয়নি।’ ফরদাবাদ গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মামুন মিয়া বলেন, ‘আমার ১৫ কাণি জমিতে প্রায় ৩শ’ মণ ধান উৎপাদন হয়। শুধু বিলের এই বাঁধের কারণে কচুরিপানা আটকে আমাদের জমি এখন চাষ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বাঁধ না দিলে কচুরিপানা আমাদের জমিতে থাকতো না। এখন আমাদের কৃষকদের মরার মতো অবস্থা।’ ফরদাবাদ গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত অপর কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, ‘মাছ চাষ করে তারা, আর ক্ষতি হয় আমাদের। তারা আমাদের এই ক্ষতি দেখে না। এই অবৈধ বাঁধের কারণে সব জমিতে কচুরিপানা ভরে গেছে। আমাদের দাবি এই বাঁধ ভেঙে দিয়ে জমিগুলো চাষের উপযোগী করে দেয়া হোক।’
মূল ইজারাদার ও ফরদাবাদ-রূপসদী ধীবর সমবায় সমিতির সদস্য পিছন দাস বলেন, ‘জমিতে আটকে থাকা কচুরিপানা আমরা পরিস্কার করে দেব।’ ফরদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ সেলিম বলেন, ‘ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ধীবর সৎস্যজীবী সমবায় সমিতি স্থানীয় কিছু পেশীশক্তি সম্পন্ন লোকজনের কাছে সাব লিজ দিয়েছে। আর এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি।তারা কারো কোন কথা শুনে না। পেশী শক্তির কাছে প্রান্তিক কৃষকরা নিরুপায়। তারা ভয়ে কিছু বলতেও পারছেন না। দ্রুত বাঁধটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়েছি। নিরুপায় কৃষকরাও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। দ্রুতই সাব ইজারারাদদের বিরুদ্ধে দ্রুতই ব্যবস্থা নেবেন বলে উপজেলা প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছেন।’
 বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সারোয়ার বলেন, ‘ইজারা নেয়া মৎস্যজীবী সমিতিকে সময় দিয়েছি, এর মধ্যে বাঁধটি অপসারণের পাশপাশি কৃষি জমিতে আটকে থাকা কচুরিপানা পরিস্কার করতেও বলা হয়েছে। নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে বাঁধ অপসারণ এবং কচুরিপানা পরিস্কার না করা হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’