সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন: ত্রিমাত্রিক বিশ্লেষণ

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা বিগত কয়েক দশকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। এ পথচলায় তিনটি বিষয় বারবার আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে: সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। এ তিনটি স্তম্ভ একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর ভারসাম্য বজায় রাখে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ বিষয়ের কার্যকরতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা।
১. সংস্কার: কাঠামোগত পরিবর্তনের অপরিহার্যতা
সংস্কার শব্দটির তাৎপর্য হলো বিদ্যমান কোনো প্রক্রিয়ার উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন। বাংলাদেশের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যখাত—সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিনের।
দৃষ্টান্ত:
স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অভাব রয়েছে, যা বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রতিবেদনেও উল্লেখ আছে (World Bank, 2018).
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগে মেধা ও দক্ষতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য বেশি গুরুত্ব পায়—এ সমালোচনা এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (TIB) একাধিক গবেষণায় (TIB, 2022)।
এ ধরনের সংস্কার যখন রাজনৈতিক স্বার্থের অনুগামী হয়, তখন জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। প্রকৃত সংস্কার তখনই কার্যকর হয়, যখন তা স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখে।
২. বিচার: ন্যায়ের বেদীমূলে রাজনৈতিক ছায়া
বিচারব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রের জন্য আস্থা, স্থিতিশীলতা ও ন্যায়ের প্রতীক। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার বিভাগ রাজনৈতিক চাপ, দীর্ঘসূত্রতা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে আস্থাহীনতায় ভুগছে।
উল্লেখযোগ্য তথ্য:
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৭৪% নাগরিক মনে করেন বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রয়েছে।
২০২৩ সালে Human Rights Watch-এর প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে “দ্রুত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” মামলা হচ্ছে (HRW, 2023)।
এছাড়া, বহু মামলায় দীর্ঘ সময় ধরে বিচার ঝুলে থাকা এবং মামলার ‘তারিখের তারিখে’ ঘুরপাক খাওয়ার অভিজ্ঞতা সাধারণ নাগরিকের মধ্যে একটি স্থায়ী হতাশা তৈরি করেছে। আইনের শাসনের অভাবে সামাজিক অস্থিরতাও বাড়ছে।
৩. নির্বাচন: গণতন্ত্রের পরীক্ষার ক্ষেত্র
নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন এখন সবচেয়ে বিতর্কিত ও অবিশ্বস্ত প্রক্রিয়ার একটি হয়ে উঠেছে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য:
২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগের রাতেই বহু কেন্দ্রে ব্যালট পূরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা বিবিসি, আল জাজিরা, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে (BBC News, 2018).
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৪৭% কেন্দ্রে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে (TIB Report, 2019)।
এছাড়া, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর মতে, নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও শক্তিহীন (সুজন, ২০২৩)।
যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও পথনির্দেশ
এ তিনটি ক্ষেত্র—সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—শক্তিশালী না হলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ তিনটি স্তম্ভের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা লক্ষণীয়।
প্রস্তাবিত করণীয়:
স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় সরকার, সিভিল সার্ভিস ও প্রশাসনিক কাঠামোতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও বিচার ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশনের আইনি ও আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সকল দলের আস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা গঠন করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির ওপর রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা নির্ভর করে। কিন্তু যদি এসব ব্যবস্থা রাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। সঠিক সংস্কার, নিরপেক্ষ বিচার এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই পারে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে।
তথ্যসূত্র
World Bank. (2018). Local Governance in Bangladesh.
Transparency International Bangladesh (TIB). (2022, 2019). Governance and Corruption Reports.
Human Rights Watch. (2023). World Report: Bangladesh Chapter.
BBC News. (2018). Bangladesh elections: Vote-rigging allegations and irregularities.
সুজন – সুশাসনের জন্য নাগরিক। (2023)। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদন।
Supreme Court Bar Association Survey Report. (2020).
