সাংবাদিকদের সম্মান ও নিরাপত্তা

 

।। মোর্শেদুল ইসলাম শাজু ।।
সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে আমাদের সমাজে ভালো এবং নেতিবাচক সব ধারণাই রয়েছে। সাংবাদিকদের নানা নামে ডাকা হয়। আমি সেই সব শব্দগুলো উচ্চারণ করে এর মানে আর আঘাত করতে চাই না। আমার দেখা আশির দশকের মাঝামাঝি এবং নব্বই দশকের শুরুর সময়ের কথা যদি বলি- তখনও সাংবাদিকতার ধরন ও মান একরকম ছিল; এখন অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। সেটা সততা, দক্ষতা এবং অর্থিক স্বচ্ছলতার নিরীখেও।

মফস্বল অর্থ্যাৎ জেলা উপজেলা শহরে বসবাস করে যারা মাঠ-ঘাট পেরিয়ে পথে প্রান্তরে চষে বেরিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করেন- সংবাদমাধ্যমগুলি কি তাদের সঠিক ও উপযুক্ত মূল্যায়ন করছে? সঙ্গে শাখা প্রশাখা মেলছে অপসাংবাদিকতা। এর জন্য দায়ী সঠিকভাবে যাচাই বাছাই ছাড়া অশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও দেশের প্রচলিত ধারা এবং আইন কানুন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না থাকা ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া। দেখা যায়, আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নাম সর্বস্ব ভূঁইফোড় অনেক পত্রিকা। এরাই পাঁচশ থেকে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে ইংরেজিতে প্রেস লেখা একটা আইডি কার্ড দিয়ে সাংবাদিক বানিয়ে ছেড়ে দেয়।

সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। বর্তমান সর্বাধুনিক যুগের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিধি নিষেধের তোয়াক্কা না করা উন্মুক্ত অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, আইপি টিভি, ফেইসবুক টিভিসহ আরও কতকিছু। এতে কিন্তু গণমাধ্যম আর সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যই গুলিয়ে গেছে।

এসবে সংবাদ প্রচার, প্রকাশ ও আদান প্রদান হলেও নিশ্চয়ই এগুলো প্রকৃত সংবাদ মাধ্যম নয়। এগুলোতো যেমন ভালো ও সত্য সংবাদ তেমনি অপসংবাদ, বস্তাপঁচা, আজব, গুজবসহ সব ধরণের সংবাদ প্রচার হয়ে থাকে। এগুলো গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। একশ্রেণির অতি ধূর্ত ও ধান্দবাজ এসব গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়ে অবমূল্যায়িত হচ্ছে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের প্রকৃত সংবাদকর্মীরা।

আজকাল দেখা যায়, কোথাও কোনো সাংবাদিক সম্মেলন, মানববন্ধন, রাজনৈতিক সভা সমাবেশ হলে বিশ-ত্রিশ জন সাংবাদিক গিয়ে হাজির হন সেখানে। শেষে পাঁচশ-একহাজার টাকা নিয়ে চলে যাবে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এদের পরিবেশিত নিউজে (!) গরম হয়ে যাবে।

এদের পাওয়া যাবে না জনগুরুত্বপূর্ণ ও মানবিক কোনো সংবাদ পরিবেশনে। কারণ এরা তো সাংবাদিকতার সূত্রও জানে না; এথিক্সই জানে না। এরা কপি সাংবাদিক। তাদের দাপটে তটস্থ থাকে মানুষ। আমার পরামর্শ হচ্ছে, ‘যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ তাদের এ পেশায় না আসাই ভালো।

বলতে শোনা যায়, “আগে সাংবাদিকদের দেখতাম খদ্দরের মলিন পাঞ্জাবী গায়, ছেড়া সেন্ডেল পায়ে আর কাঁধে একটি চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকতা করতেন। কত মহান ও মহৎ ছিল সেই সাংবাদিকরা। কেউ মারা গেলে অভাব অনটনের মধ্যেও অত্যন্ত সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করার হাপিত্তেশ দেখা যেত। আর এখন সাংবাদিকরা মারা গেলে শোনা যায় গুলশান-বনানীতে আলিশান বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট আরও কত ধনসম্পদ রেখে গেছেন। বনানী কিংবা গুলশানের সেই আলিশান বাড়িতে মরহুমের কুলখানির খবর।” এনিয়ে বিতর্ক বোধ করি ছিল এবং থাকবে। হয়তো কোনো মুর্খ ধনিক শ্রেণি অথবা আঁতে ঘাঁ লাগা নিন্দুক ব্যক্তিদের অনুসৃত ওই উক্তির কারণ। আবার আত্ম অহমিকা কিংবা ভ্রান্ত ধারণা থেকেও বলতে পারেন।

এদের কারও কারও দৃষ্টিতে সাংবাদিকরা থাকবে গরিব, অসহায়, অর্থকষ্টে কায়ক্লেশে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করবে। আর্থিক স্বচ্ছলতা তাদের থাকবে না। সৎভাবে জীবীকা নির্বাহে আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। এদের এমন ধারণা কিন্তু একেবারে অমূলকও নয়। এর জন্য দায়ী আমাদের বর্তমান কর্পোরেট যুগের সাংবাদ মাধ্যম।

বর্তমানে সাংবাদিকদরে রুটি-রুজির নিশ্চয়তা বিধানকল্পে রয়েছে ‘ওয়েজ বোর্ড’। তাও গুঁটি কয়েকজনের জন্য প্রযোজ্য। মফস্বল (জেলা-উপজেলা) পর্যন্ত তা পৌঁছায় না। এছাড়াও কেউ কেউ এর চেয়েও অধিক মাহিনা পেয়ে থাকেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিধানে রয়েছে প্রেস কাউন্সিল। দক্ষতা অর্জনে রয়েছে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট-পিআইবি। এর মাধ্যমেই সাংবাদিকদের রুটি-রুজি, নিরাপত্তা ও উৎকর্ষ সাধন করা হচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক পত্রিকাই প্রকৃত সাংবাদিকদের হাতে নেই। মালিকরা বড় বড় বণিক। তারা এগুলোকে তাদের ব্যবসার পাহারাদার হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে প্রকৃত সাংবাদিকদের মূল্যায়ন হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত অনেক প্রতিকুলতা, যখন তখন চাকুরি হারানোর শঙ্কা আর রুটি-রুজির অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই সাংবাদিকরা তাদের ঝুঁকিপূর্ণ এ পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পেশাদার সাংবাদিকদের কল্যাণে অনেক সাংবাদিক সংগঠন রয়েছে। এগুলোকে ভূমিকা যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায়ে সচেষ্ট থাকলে পেশাদার সাংবাদিকরা তাদের সার্বিক নিরাপত্তা পাবে। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। সাংবাদিকরা তাদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা, ন্যায্য অধিকার ও যথাযথ সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকুক এই প্রত্যাশা রইলো।

লেখক:প্রতিনিধি, দৈনিক আমাদের সময় ও
সভাপতি হোমনা উপজেলা প্রেসক্লাব।