সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই সব সোনালী দিন

।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ।।

প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট

আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ সেই প্রাচীনকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত ছিলো। এই ব-দ্বীপ অঞ্চলটি একাত্তর সালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে সারা বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করবার আগে ও অদ্যাবধি সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে আমরা জোর গলায় বলে থাকি। কিন্তু মাঝে মধ্যেই যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য, সম্প্রীতি ও সংহতি বিনাশকারী একটি চিহ্নিত শক্তি কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের ও সংস্থার অর্থনৈতিক সহায়তায় ও সহযোগিতায় সেই ঐতিহ্যবাহী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি তা-ও বলা যাবেনা।

একটি নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান সম্প্রতি মার্কিন মুলুকের নিঊ ইয়র্ক সিটি থেকে উন্মোচন করেছে যে, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, বাড়ি-ঘর-মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, হামলা, বেদখল ও শারীরিকভাবে আক্রমণের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থান, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের, স্বাধীনতার আগে ৩৫-৩৬ শতাংশ থেকে বর্তমানে ০৫-০৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হত্যা এবং শারীরিকভাবে নির্যাতিত লাঞ্ছিত হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগণের ক্রমান্বয়ে দেশত্যাগের ফলে এই নিন্দনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্রপূর্ণ প্রসঙ্গে কলম ধরেছি কেন তা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হতেই পারে। গতকাল (০৭ অক্টোবর) রাত ০৮-৩০ মি: নাগাদ কুমিল্লার গর্ব ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক আমোদ-এর তরুণ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ ও ভিশনারী বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক প্রিয় মহিউদ্দিন মোল্লা বাল্য-কৈশোর-যৌবন কালের এবং বার্ধক্যে এসে সাম্প্রদায়িক সহবস্থান কিম্বা সম্প্রীতি যা প্রত্যক্ষ করেছি এ যাবতকালে সে সম্বন্ধে এক হাজার শব্দে একটা নিবন্ধ লিখবার অনুরোধ জানায়। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও জানায় সে যে মঙ্গলবার (০৮ অক্টোবর) সন্ধ্যের মধ্যে লেখাটা দিতে হবে। সাধারণত: প্রিয় মোল্লা এতো কম সময়ের মধ্যে লেখা দেবার অনুরোধ এর আগে জানায়নি। একটু হতবাক হলেও একটা কিছ’ খিচুড়ি পাকাবার লোভ সংবরণ করতে পারলামনা দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে। তাই কলম নিয়ে লিখতে শুরু করে দিলাম। তাছাড়া, বেশ কটা মাস কোন প্রকার লেখা দেয়া হয়নি কোথাও।

সংবাদপত্রের পাঠক এবং টিভির দর্শক-শ্রোতা মাত্রই জানেন, গত ০৫ অক্টোবর রংপুর, কিশোরগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহত ধর্মীয় উৎসব সমাসন্ন শারদীয়া দুর্গাপূজার পূর্বাহ্নে প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। যদিও প্রশাসন থেকে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টাসহ প্রায় সব উপদেষ্টা এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সকল প্রধানগণ ও সেনাবাহিনী প্রধান এই বৃহৎ ধর্মীয় উৎসবের প্রাক্কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগণকে আশ^াস দিয়েছেন । নির্বিঘ্ন ও নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রদানের। কিন্তু দৃশ্যত: একটা ভয়ভীতির মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সারা দেশে বিশেষ করে গ্রামবাংলায় এ বছর প্রায় এক হাজার পূজা মন্ডপ কম নির্মিত হয়েছে। সাকুল্যে ৩২,০০০ পূজা মন্ডপের চাইতে কিছু বেশি মন্ডপে এবার পূজার আয়োজন করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর না করে আমাদের সোনালী দিনগুলোতে ঈদ ও পূজা–দুই প্রধান সম্প্রদায়ের সর্ববৃহত ধর্মীয় উৎসব–কিভাবে সম্পন্ন বা উদযাপন করা হতো সে সম্পর্কে কটাকথা যে না বললেই নয়।

আমরা পাড়ার বন্ধুরা তখনো বিশ^বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে স্ব- স্ব কর্মক্ষেত্রে যোগ দিইনি। সেই ১৯৭৩ সালে কুমিল্লার তালপুকুরপাড়ে “সাথীচক্র” নামে মূলত: একটা পূজা সংক্রান্ত সংগঠন গড়ে তুলি। শারদীয়া দুর্গা পূজা উদযাপনের জন্যে। এর আগে সাধারণত: আমরা সরস্বতি ও কালি পূজা উদযাপন করতাম এই সংগঠনের ব্যানারে। আমাদের পাড়ার ও অন্য পাড়ার অন্য ধর্মমতের বন্ধু-বান্ধবরা এই পূজা প্যান্ডালে আসতেন। আমাদের সঙ্গে নাচে-গানে এবং প্রসাদ গ্রহণে অংশ নিতেন। আনন্দঘন ও সৌর্হাদ্রপূর্ণ পরিবেশে । সেই উৎসবের দিনগুলোতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারী-পুরুষ সবাই একত্রে সে সোনালী সময় অতিবাহিত করতাম। আমাদের সোনালী অতীতের দিনগুলোতে।

দুর্গা পূজাকে বলা হয়ে থাকে রাজসিক পূজা। কেননা সার্বজনীন বাড়োয়ারি পূজা আয়োজনের বা প্রবর্তনের আগে পুরাকালে রাজরাজারাই এই ব্যয়বহুল এবং কঠিন ধর্মীয় নিয়মনীতির এই উৎসব বা পূজা আয়োজন করে থাকতেন। শাড়ি-ধূতি-গামছা ছাড়াও এই বৃহৎ পূজার নানান উপকরণের মধ্যে ১০৮টা রক্তপদ্মফুল এমনকি পতিতালয়ের ক্ষাণিকটা মাটিও লাগে এই পূজা সম্পন্ন করবার জন্য। সার্বজনীনতা বা সবার বা সব শ্রেণী-পেশার জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার জন্য। শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী। তাইতো দুর্গাপূজা শুধুমাত্র দেবী মহামায়া দুর্গতিনাশিনীর পূজা, আরাধনা, আরতি ও অঞ্জলি প্রদানের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনা। একটা রাজসিক কার্যক্রম হিসেবে প্রতিভাত হয় সব মহলে।

কিন্তু গোপন একটা তথ্য আপনাদের কাছে চালান না করলে যে এ লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই রাজসিক পূজা ভালোভাবে বা ত্রুটিহীন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে প্রচুর অর্থকড়িরও প্রয়োজন পড়ে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি চাঁদার একটা প্রবল ভূমিকা রয়েছে এ পূজা সফল ও সার্থকভাবে সম্পন্ন করবার নিমিত্তে। পূজার মোট বাজেটের একটা বৃহদাংশ বা বেশিরভাগ টাকা ওঠে আমাদের মুসলমান বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তা ও সহযোগিতায়। এখানেই একটি ধর্র্মীয় উৎসবের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এ দেশটা যে সেই আদ্যিকাল থেকেই রিলিজিয়াস হারমনি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ও সহবস্থানের দেশ তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। তা সে এর বিরুদ্ধবাদীরা যতই অপচেষ্টা করুক না কেন ।

এইতো গেল পূজা পর্ব। এবার আসি মূলত: ঈদুল ফিতর উৎসব নিয়ে। সম্পূর্ণ একমাস সংযম পালন ও রোজা রাখবার পর এই মহাআনন্দ উৎসবে আমরা যারা অন্য ধর্মাবলম্বী তারা অনায়াসে এবং বিনা সংকোচে যোগ দিতাম। তাছাড়া, রোজা বা উপবাস না করলে কি হবে আমাদের মুসলমান বন্ধুদের বা কোন কোন সংগঠন, ক্লাব এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ইফতার মাহফিলের দাওয়াত আমরা কখনো হারাতাম না। আর ঈদুল ফিতরের দিনতো বাল্যবন্ধু থেকে কোন কোন আত্মীয় সমতুল্য বন্ধুর বাড়িতে কোর্মা-পোলাউ, রেজালা, ফিরনি, জর্দা সমাহারে উত্তম পছন্দনীয় খাদ্যবস্তু গ্রহণ করতেই হতো। এই ছিলো সেদিনকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন। এক বন্ধুর বিপদ বা কঠিন দিনে অপর সম্প্রদায়ের বন্ধুটি যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছি, একইভাবে উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সম্প্রদায়গত ধর্মীয় উৎসবে এক অপরের সান্নিধ্যে এসেছি, শামিল হয়েছি নির্দি¦ধায় । কোন বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই। যেন আমরা সবাই এক একটা বৃহৎ পরিবারের সদস্য ও সদস্যা।

এর বাইরেও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলোতে, প্রধান প্রধান জাতীয় দিবসগুলো পালনকালে বা কোন ক্লাব বা ক্রীড়া সংস্থার কার্যক্রমে যেভাবে নানা মতের ও পথের লোকজন আমাদের দেশে একই জায়গায় সমবেত হয় তা বিশে^র বুকে একটা অনুপম বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটাকেই বোধকরি বাংলাদেশের শাশ^ত, ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হিসেবে সব মহলেই গণ্য, প্রশংসিত ও সমাদৃত এবং চিহ্নিত হয়ে আসছে। সেই পুরোনো আমল থেকে হাল আমল পর্যন্ত।

কিন্তু অত্যন্ত দু:খ ও পরিতাপের একটা বিষয় হলো, অতি সম্প্রতি আমাদের মাতৃভূমিতে যে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি উদ্দেশ্যমূলতভাবে একটি চিহ্নিত চক্র চালু করবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে তাতে করে দীর্ঘকালের ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে চিড় ধরেছে, যা কোনভাবেই যে কোন পরিস্থিতিতেই কারো কাছে কাম্য নয়। প্রত্যাশা করি, হাজারো লাখো শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমিতে সংশ্লিষ্ট সব মহলেরই শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বাংলাদেশ আবারো বিশ্বসভায় বিপুল বিক্রমে মাথা ঊঁচু করে দাঁড়াবে।
জগতের সকল প্রাণীই সুখী হোক। শারদ শুভেচ্ছা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব।
ফোন: ০১৭৩১-৫১২৭২২ ও ০১৫৫২-৩২০৯৫৭