শিশুদের সাথে ঝোলাভাতির রঙিন উৎসব

 

inside post

।। ইলিয়াস হোসাইন।।

চার দিকে পৌষের মিষ্টি কুয়াশা! বাঁশঝাড়ের ভেতর পাখ-পাখালির কলোরব!পুকুরের উপর সবুজের নিসর্গ প্রতিচ্ছবি।ভোরের শিশিরের নিঃশব্দে ঘুম ভাঙ্গা কৃষক। সরল মানুষের সাদামাটা জীবন চিত্র।এ নিয়ে আমাদের ছোট গ্রাম!কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার ৪নং দক্ষিণ খোশবাস ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রাম।এ গ্রামে প্রায় একদশক আগে গড়ে উঠা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়মিত একটি পাঠশালা ‘মানুষ’।প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এ পাঠশালায় গ্রামের অসহায় শিশুদের পড়ানো হয়।

বই-খাতা বিহীন ডিসেম্বর।চড়ুইভাতি। আমাদের গ্রামের মানুষের মুখে যার নাম হয় ‘হতিভাত’ অথবা ‘ঝোলাভাতি’। এ এক শৈশবের রঙিন উৎসব। শিশুদের নিয়ে প্রতিবছর এ চড়ুইভাতি উৎসব করে থাকি। শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সাথে দেয়া হয় শিশুদের শীত সামগ্রী উপহার।এই সকল কাজে আমার পাশে থাকেন দেশ-প্রবাসী কিছু অতি সুন্দর মনের শুভাকাঙ্ক্ষী।
চড়ুইভাতিতে প্রতিটি শিশু অংশ করেছে এক মুঠো চাল,পেঁয়াজ,রসুন,আলু দিয়ে।আমি কিনেছি গ্রামীণ পুকুরের বড় বড় তাজা মাছ,পুকুরপাড়ে রোদ পোহানো দেশি হাঁস।এবার ইচ্ছে ছিলো শিশুদের হাঁস খাওয়াবো।আল্লাহ সুন্দরভাবে কবুলও করেছেন।

তবে আগে দেখা যেতো শীত আসলেই গ্রামে হাঁসের হাঁক-ডাক ছিলো অনেক।কিন্তু এখন পুরো গ্রাম খুঁজেও যেনো দুটো হাঁস বের করা কঠিন হয়ে যায়।দু-তিন গ্রাম পড়ে অবস্থিত আমাদের এলাকার সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী ‘ফকিরা বাজার’।এ বাজার মূলত পশুর হাট-বাজার,প্রতি বৃহস্পতিবার বসে।লোকমুখে জানা যায় এখানে কোনো এক ফকির বা দরবেশ এসে আস্তানা গেঁড়ে ছিলো।সে ফকিরের নাম অনুসারে নামকরণ করা হয় ফকিরা বাজার।বর্তমানে বাজারের পাশেই ফকিরের মাজার অবস্থিত।

 

২২ ডিসেম্বর(বৃহস্পতিবার)।ছোট মামা সকালে উঠে ফকিরা বাজার থেকে হাঁস নিয়ে এসেছে।দুপুর গড়াতে শিশুদের আনন্দ উৎসব শুরু।কেউ হাঁস কাটছে,কেউ বাটছে পেঁয়াজ-রসুন-আদা। আবার কেউ আঁচড়ে তুলছে নতুন আলুর চামড়া।এক পাশে কিছু শিশু মেতেছে রুমাল চোর খেলায়।
পুরো বাড়ি উৎসব মুখর পরিবেশে ঢেকে গেছে।রান্নার মশলা উপকরণ গোছানো আগের দিনই শেষ। বাজে রাত আটটা।আপাতত সবার ছুটি।

২৩ডিসেম্বর (শুক্রবার)। চারদিকে মুয়াজ্জিনের আজান।ফজর শেষ করে বাবার কবর জিয়ারত। ঘরের দরজার মুখে বসে কোরআন তিলাওয়াত।ততোক্ষণে পশ্চিমের গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যি মামার উঁকিঝুঁকি। বাড়ির উঠোনে বসে সবার রোদ পোহানোর দৃশ্য।এ দৃশ্য শহুরের কোনো আগন্তুক ব্যক্তিকে দ্রুত মুগ্ধ করবে।

শিশুরা চলে এসেছে।মাটির গর্ত করে চুলো বানিয়ে বড় পাতিল বসিয়ে দিয়েছে মা। আমার এ এক দশকের শিশুদের পাঠশালার যতো রান্নার কাজ সকল কাজই মা এবং ছোট বোন করে।সাথে আমরা কাটা-কুটিতে সহযোগিতা করি।  প্রতি মাসে দু’বার শিশুদের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়।
সবসময় এক’শ বিশজনের উপরে আয়োজন করা হয়।শিশুদের সাথে আশেপাশের কিছু অসহায় মহিলাও আমন্ত্রণিত অতিথি হিসেবে থাকে।

প্রতিবেশী আম্মা ৮লিটার গাভির দুধ দিয়ে গেলেন।সবার প্রথমে মা পায়েস বসিয়েছেন।পায়েসের মৌ মৌ গন্ধে পুরো বাড়ি যেনো ব্যাকুল।তারপর বড় পাতিলে কষিয়ে নিচ্ছেন আলু,কিছুক্ষণ পর হাঁসের মাংসের ঝোল।আহা!এখনো ধুঁয়োয় উড়া মাংসের স্বাদ যেনো লেগে আছে।
রান্না শেষ।
শিশুরা সারিবদ্ধভাবে বসে গেছে পাটিতে।থালার ঝনঝন আওয়াজে পুরো বাড়ি মুখরিত।কেউ ঝালে হাফাচ্ছে,আবার কেউ গিলছে জল।পায়েসের বাটি হাতে নিতেই সবার ঝাল নিভে গেলো।গপাগপ খাওয়া শেষ।তারপর সবাই মিলে ফটোসেশান। ছবিতে ধরে রাখি শৈশব,রঙ,উৎসব,আমাদের উড়োনচন্ডি বয়স।এই ছবিই যেনো একসময়ের নির্জনতার অমূল্য সম্পদ।
এভাবে ধারাবাহিক আমরা মেতে থাকবো শৈশবে, রঙিন উৎসবে,চড়ুইভাতির থালার ঝনঝনানিতে।

লেখক: সংগঠক ও আলোকচিত্রী।

আরো পড়ুন