বাবা দিবস ও কিছু কথা
।। এইচ.এম. সিরাজ ।।
পিতা-পুত্র
❝ আমরা পিতা-পুত্র দু’জন
ডিজিটাল যুগ ছিলো না তখন।
তাইতো নেই মোদের একত্রে কোন ছবি
আমি বিচ্ছুরিত আলো- বাবা আমার রবি।
যার চাওয়াতে এ ধরাধামে হলো মোর আগমণ
যার তেজস্বতাতেই আমার এই অবিরাম বিচরণ।
তাঁর আলোক ধারাতেই আজও আমি চলেছি এগিয়ে
খুঁজতে চাই না আন্ধার-বিচ্যুতিকে ফের গিয়ে পিছিয়ে।❞
—————–0———— —
আলহাজ্ব মোহাম্মদ খোরশেদ মিয়া।
তিনি আমার জনক, আর আমি তাঁর ঔরসজাত সন্তান। আমার জন্মের আরও অনেকদিন আগের কথা। তিনি তখন জনগণের মাঝে রেশন বিতরণ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থাৎ সরকারের ডিলার নিযুক্ত হন। এ সঙ্গত কারণেই তদানীন্তন জেলা সদর কুমিল্লায় গিয়েই তিনাকে ছবিটি তুলতে হয়েছিলো। বাবার সাথে আমার আর কোনোই ছবি নেই। কেননা, তখনকার এনালগ যুগে যখন-তখন ছবি তোলার তেমন সুযোগও ছিলো না।
—
সেই ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। মাধ্যমিক তথা এসএসসি সমাপনান্তে উচ্চ শিক্ষার্থে আমার জেলা শহরে চলে আসা। তখনই সঙ্গে করে এনেছিলেম আমার বাবার এই ছবিখানা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হবার সময় তোলা আমার এই সাদাকালো ছবিটি বাবার ছবিটার কোণে এটাচ করে বাঁধিয়ে নেই কেবল স্মৃতি হিসেবেই। এমন জায়গাতেই ছবিটা রাখা আছে যেনো গভীর রজনীতে ঘুম ভাঙলেও অনায়াসেই দৃষ্টি চলে যায় ছবিটায়।
—
বর্তমানের এই স্যাটেলাইট যুগে বাবার অতিশয় পুরাতন এই ছবিটাকে হয়তোবা যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিকায়ন করা সম্ভব। কিন্তু কেনো জানিনা, এমনটা করতে আমার মনে কিছুতেই সায় মিলে না। কেননা, বার কতেক উদ্যোগও নিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই তা আর করতে পারিনি। এর সঠিক কোনো কারণ হয়তোবা আমার নিজের-ই অজানা।তবে হ্যা, একটা কারণ জানি। আর সেটি হলো,
আমাদের বসতঘরের পশ্চিমের দেয়ালে টানানো ছিলো বাবার হুবহু এই ছবিটা। আর সেই ছোট্টকাল থেকে এটাকে দেখে দেখেই বেড়ে ওঠেছি আমি এবং আমার অপর ভাই-বোনেরা। সেই ৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বাবার এ ছবিটা আমার সম্বল; অহর্নিশ দেখেই আসছি। আর ছবিটার দিকে তাকালেই কেমন যেনো বাবা বাবা লাগে। যেনো অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর আমায় দরাজ গলায় ডেকে বলছে———————–!
—
আজকে দিবসের শুরুতেই ফেসবুক জানান দিলো এক খবর। ‘আজ বাবা দিবস’। আহবান জানালো একটি ফটো সংযোজন করার। যদিও ‘মা-বাবা’ নিয়ে কোনো দিবসই আমি মানিনা, কিন্ত যিনি আমায় এই ধরাধামে আনলেন, সেই বাবার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে কি অকৃপণ হতে পারি? আর ছবিটা আপলোড করে মনে জন্মানো এইসব পদ্য-গদ্য আওড়ালাম। হয়তোবা বেহুদা প্যাঁচাল পাড়লাম কীনা, ঠিক তাও বলতে পারছিনে।
—
❝ মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়
পিতৃস্নেহের কাছে হয়েছে মরণের পরাজয়। ❞
— সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসা এতোটাই স্বার্থহীন যে, সন্তানের জন্য নিজের প্রাণ দিতেও তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না। কেননা, বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন, পরিবারের খুঁটি-বাতিঘর। বাবার তুলনা তিনি নাজেই। বাবা মানেই নির্ভরতার এক আকাশ আর নি:সীম নিরাপত্তার চাদর। আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। এনসাইক্লোপিডিয়া জানাচ্ছে, জুন মাসের তৃতীয় রোববারটি বিশ্বের প্রায় ৭৪ দেশেই বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়। সেই হিসেবে আজ গোটা বিশ্বজুড়েই পালিত হচ্ছে বাবা দিবসটি।
—
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম বাবা দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সসে বছর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টে ৫ জুলাই এ দিবস পালন করা হয়। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট লিণ্ডন বি জনসন জুন মাসের তৃতীয় রোববারটিকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাবা দিবস’ হিসেবে নির্ধারণ করেন। ছয় বছরের মাথায়, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতিবছরই জাতীয়ভাবে ‘বাবা দিবস’ পালনের রীতি চালু করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্যাটেলাইট যুগের বদান্যতায় ‘বাবা দিবস’ বেশ ঘটা করেই পালিত হচ্ছে। তবে এই নিয়ে সমালোচনাও কম নয়। সমালোচকেরা বলেন, বাবাকে স্মরণ করতে শুধু একটি দিনই-বা কেন! কেউ কেউ বলে থাকেন, বাবা দিবসটা ঠিক আমাদের জন্য নয়, এটি মূলত পাশ্চাত্যের।
—
বাবা। রাগ শাসন আর রাশভারী চেহারার আবডালে এ মানুষটির যে কোমল হৃদয় থাকে, তা মাতৃহৃদয়ের চেয়েও কম নয়। ‘মা’ এর মতো ‘বাবা’ও ছোট্ট এই শব্দটির গভীরতা অতলান্ত-অসীম। পবিত্র কোরআনে সুরা আহকাফের ১৪ নম্বর আয়াতে, বনী ইসরাইলের ২৪ নম্বর আয়াতে, সুরা আন নিসার ৩৬ নম্বর আয়াতে, সুরা লোকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা পিতা-মাতার খেদমত করার নির্দেশ দিয়েছেন। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া আল্লাহ্’র কাছে পৌঁছাতে কোনো আড়াল থাকে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পিতা-মাতা জান্নাতের মাঝের দরজা। যদি চাও, এই দরজাটি নষ্ট করে ফেলতে পারো, নতুবা তা রক্ষাও করতে পারো। (তিরমিযী, তুহফাতুল আহওয়াযী, ৬/২৫)। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তার নাক ধূলায় মলিন হোক (৩ বার), সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহ্’র রাসূল! কে সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটি? প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেলো অথচ তাদের সেবা করার মাধ্যমে জান্নাত হাসিল করতে পারলো না’ (মুসলিম-৪/১৯৭৮)। রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত'(তিরমিযি)
—
যদিও বাবা বলে ডাকার মতো আমার কেউই আজ এই ভুবনে নেই। চিরতরে আমি পিতৃহীন, বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কেমন আছেন আমার বাবা? মহান আল্লাহ্ আমার বাবাকে কেমন রেখেছেন? কেবল আমি কেন, তামাম জাহানের কারোর পক্ষেই কি সেই খবরটি জানা সম্ভব?কদ্যপিও নয়। হ্যা, মহান আল্লাহ্’র দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, তিনি যেনো মায়া করে আমার বাবাসহ পরপারে যাওয়া সকল বাবাদেরকে ওনার নিজ জিম্মায় রাখেন। পাশাপাশি এও বলবো, ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বাবারা। আজকের দিবসে এটাই আমার কামনা। কোনো বাবাকেই যেনো ভারতীয় জীবনমুখী গানের সেই বিখ্যাত শিল্পী নচিকেতা’র অত্যন্ত জনপ্রিয় গানটা না গাইতে হয়-
❝ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটের যায়না দেখা এপার ওপার,
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী
সবচে’ কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলের আবার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম-
অমার ঠিকানা তাই এই বৃদ্ধাশ্রম।।
আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না,
ওসব নাকি বেশ পুরনো, ফ্ল্যাটে রাখা যায়না।
ওর বাবার ছবি ঘড়ি ছড়ি বিদেয় হলো তাড়াতাড়ি
ছেড়ে দিলো, কাকে খেলো পোষা বুড়ো ময়না।
স্বামী-স্ত্রী আর এ্যালসেশিয়ান জায়গা বড় কম-
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।।
নিজ হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা,
বলতাম আমি না থাকলে, কি করবি রে বোকা।
ঠোট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে,
খোকা বোধয় আর কাঁদেনা নেই বুঝি আর মনে।
ছোট্ট বেলায় স্বপ্ন দেখে ওঠতো খোকা কেঁদে,
দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে।
দু’হাত আজও খুঁজে ভুলে যায় যে একদম-
আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম।।
খোকারও হয়েছে ছেলে দু’বছর হলো,
আর তো মাত্র বছর পঁচিশ ঠাকুর মুখ তুলো।
একশ’ বছর বাঁচতে চাই এখন আমার ষাট,
পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট।
আশ্রমের এই ঘরটা ছোট জায়গা অনেক বেশি,
খোকা আমি দু’জনেতে থাকবো পাশাপাশি।
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণরকম-
মুখোমুখী আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম।। ❞
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। আজকের এই দিবসে এমনি কামনার পাশাপাশি সকল ফেসবুক বন্ধুদের প্রতি থাকলো বর্ণালী শুভেচ্ছা আর অফুরান শুভ কামনা।
#
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব। ই-মেইল : serajhm@gmail.com