নগরীর তেরিপট্টি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
|| আবদুল আজিজ মাসুদ ||
পট্টির শহর কুমিল্লা। শুধু কুমিল্লা কেন সব শহরেই পট্টি রয়েছে কমবেশি। নামেই বলে দেয় কোন পট্টি কিসের জন্য। খুব সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, বাজার বা শহর গঞ্জের যে অংশে যে পণ্য পাওয়া যায় বা যে এলাকায় যে বর্ণ বা পেশার লোকজনের বসবাস সে নামেই পট্টির নাম। যেমন পান পট্টিতে সকল পান ব্যবসায়ী, মুচি পট্টিতে শহর নগরের সকল মুচির বসবাস। এখন কথা হলো চকবাজারের ‘তেরি পট্টি’ বা ‘টেরি পট্টি’ নিয়ে ? আসলে টেরিটা কি ? চকবাজারের পশ্চিম দিকের প্রবেশ পথের এ অংশকে তেরিপট্টি বলা হয় কেন ?
কুমিল্লার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে চর্চা করেন এমন একজনের অভিমত, ‘‘চকবাজার, মোগলটুলী, সংরাইশ এলাকার লোকজনের পছন্দের খাবার তেহারি তাই তেহারি থেকে এই পট্টির নাম তেরিপট্টি হতে পারে। অর্থাৎ বাজারের এ অংশে সারি সারি দোকানে তেহারি বিক্রি হতো, এ জন্য এ পট্টির নাম তেরিপট্টি। আসলে কি এ পট্টিতে কখনো তেহারি বিক্রি হতো? শহরের প্রবীণ অনেকেই এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। বরংচ মোগলটুলীর ‘ঐতিহ্যবাহী হাড্ডিশাহ্’ এর তেহারির কথা কেনা জানে ? এক সময় শহরের ভোজন রসিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়তো হাড্ডিশাহ্র এক প্লেট তেহারির জন্য। অনেকের সকালের নাস্তায় হাড্ডিশাহ্র তেহারি না থাকলে চলতোই না। মোগলটুলীর লোকজন কেন যাবে চকবাজারে তেহারি খেতে? অন্য এক গবেষক মনে করেন নানা রকম পণ্যের সমাহারের কারণে এর নাম ‘‘তেরিপট্টি’’। এই গবেষক নানা রকম পণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, বুট, বাদাম, পেঁয়াজ মসলার কথা বলেছেন কিন্তু ‘তেরি’ নামের কোন পণ্যের কথা বলেননি। অন্য একজন মনে করেন চকবাজারের প্রবেশের এই রাস্তাটা একটু তেরা বা বাঁক রয়েছে এ জন্য এই পট্টির নাম ‘‘তেরিপট্টি”।
‘‘তেরিপট্টি” নামের উৎপত্তির ইতিহাস অনুসন্ধানে গবেষকদের উপরোক্ত অভিমত সমূহ ছাপিয়ে নগরের নানুয়া দিঘির পাড়ে একজন প্রবীণ নাগরিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক (করোনা সূচনালগ্নে প্রয়াত) ডা: হারুন অর রশিদের অভিমতকে প্রাণিধান যোগ্য মনে হয়েছে। তাঁর অভিমত হলো, এ পট্টিতেই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী হুক্কা বেঁচা কেনা হতো। ‘এ পট্টির একাংশেই ছিল হুক্কা পট্টি। এই হুক্কা শিল্পকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল তামুক পট্টি, টিক্কারচর, টিক্কার ব্যবসা এবং ‘তেরি’ বা ‘টেরি’ বীজের ব্যবসা। এ জন্য বাজারের এই অংশের নাম ‘তেরি’ পট্টি বা ‘টেরি পট্টি’। সীমের বীজের ন্যায় তৈরি বীজ, স্থানীয় পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করে হুক্কার নারকেলের ডাবা বা খোলকে কালো রং করা হতো। টেরির বীজের নির্যাস আর আঠালো ইরার কষ এর সংমিশ্রণে কড়া জ¦ালে এ রঙ তৈরি হতো। এটা আসলে গুরু বিদ্যা। উস্তাদের নিকট না শিখলে সঠিকভাবে এ রঙ তৈরি সম্ভব নয়। ডাক্তার হারুনের এ বক্তব্যের সত্যতা পাই গল্পকার কাজী মোহাম্মদ আলমগীরের ‘‘টেরির বীজ ও ইরার কষ” ছোট গল্পে। তিনি তার গল্পে টেরির বীজ আর ইরার কষের শক্ত আঠা দিয়ে হুক্কার রঙ তৈরির গোপন কৌশলের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। রঙ করার এ কৌশল শুধু পুরুষ সদস্যদেরকেই শিখানো হতো। নারীর মাধ্যমে এ কৌশল অন্য পরিবারে চলে যাবে এ আশংকায় রঙ তৈরির সময় কোন নারী চতুর সীমানায় আসা নিষিদ্ধ। কাজী আলমগীর তার গল্পের নায়ক ধনু মিয়া তার স্ত্রীর বহু কাকুতি মিনতির পরও রঙ তৈরির এ কৌশল শিখায়নি। রঙ তৈরির গোমর ফাঁসের অজানা আশংকায়।
হুক্কাসেবীরা এখন আর হুক্কা টানে না, নামি দামি সিগারেট টানে, এমন কি বিড়িও টানেন কম, তাই ‘টেরি পট্টির’ কোন বাইন্না দোকানে ইরাকষি, টেরির বীজ মিলে না, অনেক দোকানি নামও জানে না।
এই পট্টিতে মাছ ধরার জাল রঙ করার জন্য কাঁচা দেশী গাব পাওয়া যেত সাপ্তাহন্তে। বাগমারা থেকে কাঁঠাল কাঠের খড়ম নিয়ে আসতো খড়ম বিক্রেতারা। এখানে হরেক রকম খড়ম পাওয়া যেত। দরিদ্র শ্রেণির জন্য পুরাতন রিক্সা সাইকেলের টায়ারের দুই/ এক ইঞ্চি চওড়া নৌকার ছই এর মত দোয়াল ওয়ালা খড়ম। ধনীরা পড়তো বইলা ওয়ালা খড়ম। উচু হিল ওয়ালা এই খড়ম ব্যবহার করা বেশ জটিল। বইলার ফাঁকে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে হাঁটার অভ্যাস না করে স্বচ্ছন্দে হাঁটা সম্ভব নয়। এখন খড়ম ব্যবহার বিলুপ্তির পর খড়ম পট্টিও নেই, খড়মও নেই।
একবার জনান্তিক নাট্য সম্প্রদায়ের এক নাটকে প্রবীণ সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী নারদের ভূমিকায় অভিনয় করবেন। চরিত্রের প্রয়োজনে বইলা ওয়ালা খড়মের প্রয়োজন। কিন্তু বইলা ওয়ালা খড়ম পাওয়া যাবে কোথায় ? অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধান পাওয়া গেল ‘‘পুলিশ লাইন জামে মসজিদের ইমাম সাহেব বইলা ওয়ালা খড়ম পরেন। কিন্তু বিপত্তি হলো নাটকের জন্য ইমাম সাহেব খড়ম দেবেন কি না। শেষ পর্যন্ত এক জোড়া খড়ম জোগাড় করা হয়েছিল। ইমাম সাহেবের কিনা জানি না, তবে খড়ম জোড়া অনেক ছোট। মঞ্চে দেখা গেলো মোস্তাফা ভাইয়ের পায়ে অর্ধেক অংশ খড়মের বাইরে।
আর এক নিষিদ্ধ পট্টির কথা ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন। সেটা হলো কুমিল্লার ক্ষত বর্তমান চকবাজার বাসস্ট্যান্ডের স্থানে ‘‘বেশ্যা পট্টি” বা ‘‘বেশ্যা পাড়া”, তবে সাধারণত বেশ্যা শব্দটা উচ্চারণে অনেকের মুখে বাঁধতো বিধায় সবাই এই নিষিদ্ধ পল্লীকে ‘‘পাড়া” ই বলতো। কালের সাক্ষী ডাক্তার হারুন বলেন, এই পাড়াকে কেন্দ্র করে পাড়ার আশপাশ এলাকায় শহরের কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তির বিনোদনের জন্য সংগোপনে গড়ে উঠেছিল কিছু বাসা বাড়িতে মিনি পতিতালয়। যারা লোকলজ্জার ভয়ে নিষিদ্ধপাড়ায় যেতে সংকোচ করতো তারা তাদের আতিথ্য গ্রহণ করতো। এ প্রসঙ্গে ডাক্তার সাহেব বলেন, গর্জন খোলা এলাকার জনৈক ব্যক্তি তার দুই কন্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য চেম্বারে আসেন এবং ঔষধ নিয়ে চলে যান। এমনি ভাবে প্রায়ই নতুন নতুন কমবয়সী তরুণী নিয়ে আসেন চিকিৎসা নিতে। সকল মেয়েকে তার কন্যা বলে পরিচয় দেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মনে প্রশ্নজাগে এই ভদ্রলোকের কন্যা কতজন ? আর সব সমবয়সীই বা কেন ? পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আসলে উনি নিজ বাসায় শহরের কিছু তথাকথিত অভিজাত ব্যক্তিবর্গের জন্য নারী সঙ্গের ব্যবস্থা করতেন। এমনি ভাবে ‘‘পাড়ার” আশপাশ এলাকার বেশ কিছু পরিবারের কথা বলেন যারা এই আদিম ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন বা এই নিষিদ্ধ পল্লীর সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত ছিলেন। দালালীও করতেন অনেকে। তাছাড়া এই ‘‘পাড়া” কে কেন্দ্র করে মদ গাঁজার ব্যবসা ও ছিল জমজমাট, মেথর পট্টি, মুচি পট্টিতো চোলাই মদের বাগাড়। সম্ভবত এই ‘‘পাড়া’’ কে কেন্দ্র করেই ধনাঢ্য তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির জন্য ঐ এলাকায় সরকারের অনুমতি নিয়ে বিদেশি মদের ব্যবসা শুরু করে ছিল” নাদের এন্ড কোং”।
শিক্ষা সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লায় এক সময় এই নিষিদ্ধ পল্লীকে কেন্দ্র করে নারী মদ নিয়ে নোংরামীও কম হতো না। এখন যেমন পাড়ায় পাড়ায় ফেন্সিডিল, হেরোইনে নেশাগ্রস্ত তরুণের দেখা মেলে তখনও প্রায় মহল্লাই দেখা যেতো মদ্যপায়ীদের। গভীর রাতে মাতালদের মাতলামি, পারিবারিক কলহ, ঝগড়া ঝাটি, মারামারি, নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা ছিল। আমাদের মোগলটুলী, চৌধুরী পাড়া, মদন পট্টির প্রায় ঘরেই নেশার কলহ শৈশবে প্রত্যক্ষ করেছি।
লেখকঃ- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট, মোবাইল : ০১৭১১-৪৬৪২১৩।