নেতারা এবার জবানে লাগাম দিন

মনোয়ার হোসেন রতন।।

একজন চিত্রশিল্পী জানেন, তুলির প্রথম আঁচড় কোথায় ফেলতে হবে এবং শেষ টানটা কেমন হতে হবে—নইলে শিল্প হয় না, হয় কেবলই কোলাহল। ঠিক তেমনি, রাজনীতিও একটি শিল্প। এখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি বক্তব্য ক্যানভাসে আঁকা তুলির মতো—যা গঠনমূলকও হতে পারে, আবার ধ্বংসাত্মকও। অথচ আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি যেন এক শব্দ-যুদ্ধের মঞ্চ। যেখানে চিন্তা নেই, বিবেচনা নেই, নেই দায়িত্ববোধ—শুধু আছে মুখ খুলে যাচ্ছেতাই বলার এক প্রবণতা।

সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ২০২৫ সালের ১৬ জুলাই আমার দেশ পত্রিকায় লিখেছেন: “নেতারা এবার জবানে লাগাম দিন”। তাঁর এই বক্তব্য শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং এক নির্মম বাস্তবতাকেও উন্মোচিত করেছে—যেখানে রাজনৈতিক ভব্যতা, বোধ এবং শালীনতা আজ সংকটাপন্ন। তিনি ঠিকই বলছেন, ‘হাসিনা সিনড্রোমে’ আক্রান্ত রাজনীতিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমন সব কথা, যা একজন ভদ্রলোকের মুখে মানায় না—তা আজ রাজনৈতিক বক্তৃতায় ঢুকে পড়েছে।

বাক-স্বাধীনতা কি উচ্ছৃঙ্খলতার লাইসেন্স?

রাজনৈতিক বাক-স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, আপনি যা খুশি তাই বলবেন। বাক-স্বাধীনতার সীমানা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। আপনি কারো চরিত্র হনন করতে পারেন না। আপনি মিথ্যার রাজনীতিকে সত্যের মোড়কে সাজাতে পারেন না।
জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘হাসিনা সিনড্রোম’ বলাটা এক রকম শ্লেষ হলেও, এই কথার মধ্যে এক গভীর সত্য লুকিয়ে আছে। কারণ এই দেশে আজ রাজনৈতিক পরাজয়ের জ্বালায় অনেকে একধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ততার মধ্যে পড়ে গেছেন—যার প্রকাশ ঘটছে কুরুচিপূর্ণ ভাষায়, নোংরা মন্তব্যে, অবমাননাকর বক্তৃতায়।

রাজনীতি কি শুধুই কটুক্তির মঞ্চ?

আজ রাজনীতির মঞ্চে কেউ কাউকে সম্মান করতে জানে না। একটা সময় ছিল, যখন ভিন্নমত পোষণ করলেও রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা—তাঁরা সবাই রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষ ছিলেন, কিন্তু কখনো একে অপরকে শত্রু মনে করতেন না। আজ সে ঐতিহ্য কোথায়? এখন শুধু গালি-গালাজ, ব্যক্তিগত আক্রমণ, মা-বোন তুলে অশালীন মন্তব্য।

নেতৃত্ব মানে ভাষার মার্জনা

একজন প্রকৃত নেতা তখনই বড় হন, যখন তিনি ভাষা ও বোধের ভারসাম্য রক্ষা করেন। নেতৃত্বের মূল শক্তিই হলো—তিনি কী বলেন, কখন বলেন, কীভাবে বলেন।
আমরা যখন বলি “নেতারা এবার জবানে লাগাম দিন”, তখন আসলে বলছি, আপনারা নেতা, গালিবাজ না। সমাজ আপনাদের দেখে, অনুসরণ করে। আপনি যখন একজন নারী নেত্রী সম্পর্কে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন, তখন আপনার চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়, রাজনীতি কলঙ্কিত হয় এবং সমাজ বিভ্রান্ত হয়।

রাজনীতির সৌন্দর্য কোথায়?

রাজনীতি হলো জনগণের আস্থা অর্জনের পথ, গালি-গালাজের না। রাজনৈতিক বক্তৃতা যেন এখন ট্র্যাশ টকের মঞ্চ হয়ে গেছে। কেউ আর নীতি নিয়ে কথা বলে না, পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলে না, শুধু ব্যক্তিগত রোষ, প্রতিহিংসা, অপমান আর বিকারগ্রস্ত ভাষার বৃষ্টি।
এই প্রবণতা এখনই থামাতে হবে। থামাতে হবে কেবল রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মেধা নয়, মুখই মুখর। যেখানে যুক্তি নয়, উন্মাদনাই নিয়ন্ত্রক শক্তি। এর জন্য দায়ী কেবল রাজনৈতিক নেতা নন, দায়ী আমরা সবাই—যারা এই উচ্ছৃঙ্খলতাকে তালি দিয়ে উৎসাহ দেই।

একটি নতুন শুরুর প্রয়োজন

আজ যদি আমরা চাই একটি গণতান্ত্রিক, সৌহার্দ্যময় ও যুক্তিনির্ভর রাজনীতি—তাহলে আমাদের প্রথম কাজ হবে রাজনীতিকে শব্দের শালীনতা ফিরিয়ে দেয়া। রাজনীতি যেন ধিক্কারের বিষয় না হয়, বরং শ্রদ্ধার জায়গা হয়ে ওঠে।
জনগণ চায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। এই চাওয়ার জবাব একমাত্র নেতারাই দিতে পারেন—যদি তাঁরা ভাষা বেছে ব্যবহার করেন, জবানির লাগাম ধরেন এবং রাজনীতিকে পুনরায় সভ্যতার পথে ফেরত আনেন।

মাহমুদুর রহমানের লেখার সঙ্গে আমি একমত। আজ বাংলাদেশে রাজনীতি নয়, ব্যক্তিত্বের সংকট চলছে। এই সংকট ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এখনই সময়, এই বিকারগ্রস্ততা থেকে মুক্তির।
নেতারা, এবার সত্যিই—জবানে লাগাম দিন!

inside post
আরো পড়ুন