ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস নিয়ে কিছু কথা
।। এইচ.এম. সিরাজ।।
“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।”
আমি বিজয় দেখিনি
বিজয়ের গল্প শুনেছি।
আমি বশ্যতা মানিনি
বিজয় ছিনিয়ে এনেছি।
আমি আপোষ করিনি
গৌরবে বাঁচতে শিখেছি।
আমি বহু রক্ত খুইয়েছি
বিজয়ের মাস পেয়েছি।
গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, বিজয়ের মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি চিরকালেরই বীর, তারই প্রমাণ একাত্তর, মহান মুক্তিযুদ্ধ; যার ফসল বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এখান থেকে রেল-সড়ক-নৌপথে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ ছিলো সহজতর। সীমান্তের ওপার ভারতে প্রশিক্ষণান্তে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এই জনপদ দিয়ে দেশাভ্যন্তরে প্রবেশ করার পরই যেতো অন্যত্র। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবেশদ্বার ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এজন্যে এখানটাতেই পাকিস্তানীদের ছিলো শ্যানদৃষ্টি, চালাতো সাড়াশী অভিযান। তৎকালে এই মহকুমার প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়ায় মুক্তিযুদ্ধে। সঙ্গতেই মুক্তিযুদ্ধ পরিণত হয় মূলত এক জনযুদ্ধে। আর তা চলে চূড়ান্ত বিজয়ের আগ মুহূর্ত অবধি। বিজয়ের মাত্র আট দিন আগে, ৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
—
আজ ৮ ডিসেম্বর, নিত্যদিনের মতো একটি দিন হলেও এতে রয়েছে খানিকটা বিশেষত্ব-ঐতিহাসিকতা। আর তা হলো, আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস। রক্তস্নাত মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নানাবিধ কারণেই জনপদটি মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার নামে খ্যাত, আর এই সূতিকাগার হানাদার মুক্ত হয়েছিলো ৮ ডিসেম্বর, অর্থাৎ আজকের দিনটাতেই। সঙ্গতেই দিনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর কাছে অতীব স্মরণীয় আর গুরুত্ববহ। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয়টি মাস জুড়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হয় সম্মুখযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সমগ্র বাংলাকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টরে। আবার প্রত্যেকটা সেক্টরকেও বিভক্ত হয় কতেক সাব-সেক্টরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণাংশ, দক্ষিণ-পূর্ব কসবা, আখাউড়া এবং গঙ্গাসাগর থেকে পশ্চিমে ভৈরববাজার রেললাইন পর্যন্ত ২নং সেক্টর। বর্তমান বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল থেকে উত্তরে হবিগঞ্জ পর্যন্ত ছিলো ৩নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত।
—
যুদ্ধকালে ২নং সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ (পরে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) তাঁর সেক্টরকে বিভক্ত করেন ছ’টি সাব-সেক্টরে। তন্মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আখাউড়া,গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইন উদ্দিন (পরে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল পিএসসি)। এই সাব-সেক্টর কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সৈয়দাবাদ, আখাউড়া, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর এবং কুমিল্লার মুরাদনগর পর্যন্ত অপারেশন চালাতো। নিয়মিত-অনিয়মিত এবং প্রশিক্ষিত গেরিলা সৈনিকদের নিয়ে অক্টোবর মাসে গঠন করা হয় নবম বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মন্দভাগ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এইচ.এম.এ গাফফার (পরে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত লে. কর্ণেল)। তদাধীন চতুর্থ বেঙ্গলের ‘সি’ মানে ‘চার্লি’ কোম্পানি এবং মর্টারের একটি দল অপারেশন চালাতো মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন থেকে কুটি পর্যন্ত। এছাড়া সালদানদী কোনাবন সাব-সেক্টর কমাণ্ডারও ছিলেন তিনিই। তাঁর কমাণ্ডে প্রায় চৌদ্দশ’র মধ্যে প্রায় আটশ’ ব্যাটালিয়ন সৈন্য ও প্রায় ছয়’শ সাব সেক্টর ট্রুপসে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ এবং যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণে গড়া সৈনিকরা ব্যাটালিয়নের অন্তর্ভূক্ত। আর ছাত্র-যুবক-কৃষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো সেক্টর ট্রুপসে।
—
ক্যাপ্টেন গাফফারের ব্যাটালিয়নে কোম্পানি ছিলো চারটি। তন্মধ্যে (এ) আলফা’র কমাণ্ডার সুবেদার গোলাম আম্বিয়া। ‘ব্রাভো’র (বি) কমাণ্ডার সুবেদার ফরিদ, (সি) ‘চার্লি’র কমাণ্ডার সুবেদার আব্দুল ওহাব (বীরবিক্রম) এবং (ডি) ‘ডেল্টা’র কমাণ্ডার ছিলেন সুবেদার তাহের। ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমাণ্ড ছিলেন লেফটেন্যান্ট কবির (পরে ক্যাপ্টেন)। এর দুটো মর্টার প্লাটুনের একটির কমাণ্ডার সুবেদার জব্বার ও অন্যটির সুবেদার মঈন (বীরউত্তম)। যুদ্ধের বাস্তবতায় প্রায়শ এক সেক্টরের সদস্য অন্য সেক্টরেও যুদ্ধ করে। ২নং সেক্টরাধীনে প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা এবং ছ’হাজার নিয়মিত বাহিনীর সদস্য যুদ্ধ করে।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা অপারেশনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদেরকে সর্বদা রাখতো সন্ত্রস্ত। সালদানদী, বায়েক, মন্দভাগ, নয়নপুর, কসবা, গঙ্গাসাগর, আখাউড়াসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় দখলদার পাকিস্তানীদের সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রায়শই হতো সম্মুখযুদ্ধ। মার্চ থেকে ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের আগ মুহূর্ত অবধি যুদ্ধ হয়েছে এই জনপদে। এজন্যই ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমিও বলা হয়। যুদ্ধকালীন নয়টি মাসজুড়ে মূলত সীমান্ত অঞ্চল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনী তথা সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। বিজয়ের অনেকটা দ্বারপ্রান্তে এসে আজকের দিনেই সীমান্তবর্তী এই জনপদ পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিলো। ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হামলার পর ৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত পুরো জেলা ছিল রণাঙ্গন এলাকাটি। একাত্তরের এদিনে মুক্তি পাগল জনতা স্বজন হারানোর সব ব্যথা ভুলে গিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ বাতাস করে তুলেছিলো মুখরিত। আজকের দিনেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরাতন কাচারি ভবন সংলগ্ন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।
—
একাত্তরের ৩০ নভেম্বর থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত করতে পূর্বাঞ্চলেরর প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় মিত্রবাহিনী পাক বাহিনীর ওপর বেপরোয়া আক্রমণ চালাতে থাকে। পরদিন ১ ডিসেম্বর আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় সংঘটিত প্রচণ্ড যুদ্ধে নিহত হয় ২০ হানাদার। দু’দিন পর ৩ ডিসেম্বর আখাউড়ার আজমপুরে হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। সেখানে নিহত হয় পাকিস্তানি ১১ হানাদার, শহীদ হন তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। এর পরদিন ৪ ডিসেম্বর হানাদাররা পিছু হটতে থাকলে আখাউড়া অনেকটাই শত্রুমুক্ত হয়। আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের তুমুল যুদ্ধে পাক বাহিনীর দু’শতাধিক সেনা হতাহত হয়। এর মাত্র দু’দিন পর অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর আখাউড়া সম্পূর্ণভাবে হানাদার মুক্ত হয়।
—
পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার খ্যাত আখাউড়া মুক্ত হবার পরই চলতে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে হানাদারমুুক্ত করার প্রস্তুতি। মুক্তি বাহিনীর একটি অংশ শহরের দক্ষিণ দিক থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে এবং মিত্র বাহিনীর ৫৭তম মাউন্টের ডিভিশন আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেললাইন এবং উজানীসার সড়ক দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। সেসময় শহরের চতুর্দিকে মুক্তিবাহিনী শক্ত অবস্থানে থাকায় খান সেনারা পালাবার সময় ৬ ডিসেম্বর রাজাকারদের সহায়তায় চালায় নির্মম-পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের তদানীন্তন অধ্যাপক কে.এম.লুৎফুর রহমানসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে আটকে রাখা অর্ধশত বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে চোখ বেঁধে শহরের দক্ষিণ প্রান্তের কুরুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।পরদিন ৭ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে পাকিস্তানি দখলদার সামরিক জান্তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে আশুগঞ্জের দিকে পালাতে থাকে। শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় কলেজের হোস্টেল, অন্নদা স্কুল বোডিং, বাজার ও গুদামসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ফলে ৮ ডিসেম্বর অনেকটা বিনা বাধায় বীর মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। মুক্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।সেই থেকে ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এদিকে একই দিন সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পার্শ্ববর্তী সরাইল উপজেলাও হানাদার মুক্ত হয়। আজকের এই দিনে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
#
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, পাঠাগার ও ক্রীড়া সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।