হজ্বকালীন স্বাস্থ্যের যত্ন
।। অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ।।
১। সৌদি আরবে থাকাকালীন শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে হাত ও পায়ের তালু ফেটে যায়, চামড়া উঠতে আরম্ভ করে। তাই নিয়মিত ভেসেলিন বা ময়েশ্চারাইজার লোশান ব্যবহার করতে হবে।
২। আরবে থাকা অবস্থায় ঠান্ডা-কাশি থেকে রক্ষা পেতে সাবধান হোন। প্রচন্ড গরম থাকা সত্ত্বেও ঠান্ডা পানি পান ও ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। ঠান্ডা থেকে গলার স্বর বসে যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত কুসুম গরম লবণ পানি দিয়ে গরগরা করুন।
৩। হজ্জ্বে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয় এ কারণে পায়ে বা তালু ফাঁটা বা ফোসকা পড়তে পারে। এক্ষেত্রে খালি পায়ে হাঁটা পরিহার করুন।
৪। মধ্যপ্রাচ্য ও সৌদিতে মার্স ভাইরাসের সংক্রমন ঘটেছিল। এ রোগ প্রতিরোধে উটের কাঁচা দুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৫। হজ্জ্বের সময়ে হাঁটাহাটির কারণে প্রায়ই পা ব্যথা করে এজন্য শোয়ার আগে পা মেসেজ করুন।
৬। হজ্জ্ব যাত্রার আগেই নির্ধারিত রোগ কোভিড-১৯ এর পূর্ণ ডোজ (বুষ্টারসহ) টিকা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মেনিনজাইটি ইত্যাদি টিকা গ্রহণ করুন।
৭। অনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে অত্যাধিক পরিশ্রম করলে অসুস্থ হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ আমল পালনে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাই অত্যাধিক পরিশ্রম ত্যাগ করে পরিমিত বিশ্রামে সময় অতিবাহিত করতে হবে।
৮। আগে থেকেই কোন রোগে আক্রান্ত থাকলে যাত্রার আগেই নিরাময় ও নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ ঔষধ সঙ্গে রাখুন এবং নিয়মিত ঔষধ সেবন করুন।
৯। হজ্জ্বকালীন জনসমাগমে প্রচুর ধূলাবালি থাকায় হাঁপানী, শ্বাসকষ্ট বা কোভিড-১৯ হওয়ার প্রবণতা থাকায় যথাসম্ভব নাক, মুখ ঢেকে রাখুন/মাস্ক পড়ুন। হাঁপানি, এলার্জি, হাইপার টেনশন ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ঔষুধ নিয়মিত সেবন করুন। প্রচন্ড গরম, ঠান্ডা পানি, ঠান্ডা বাতাস, ধুলাবালি থেকে দূরে থাকুন। রুমের কার্পেটের ধূলাবালি যেন নাকে না ঠুকে সে ব্যবস্থা নিন।
১০। দাঁতের সমস্যা থাকলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং নিয়মিত দাঁতের যত্ন নিন। দাঁত পরিষ্কারে নরম ব্রাশ ব্যবহার করুন। ঘুমানোর সময় ও সকালে দাঁত ব্রাশ করুন।
১১। চল্লিশোর্ধ যাত্রীরা কোন সুপ্ত রোগের ব্যাপারে ভাল করে চেক আপ করুন। দুই ফিতাযুক্ত স্যান্ডেলে হাঁটার চেষ্টা করুন এবং কমপক্ষে দুই জোড়া স্পঞ্জের সেন্ডেল সঙ্গে নিন।
১২। বিভিন্ন গুরুতর হৃদরোগ ও কিডনি রোগে ভুগছেন যারা তাঁরা পাহাড়ে উঠা বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকুন।
১৩। দুপুরের রোদে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করুন। ১/২ থেকে ১ ঘন্টা পর পর পানি পান করুন। অতিরিক্ত গরম অনুভূত হলে মাথায় শরীরে পানি ঢালতে পারেন। তবে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এসি নিয়ন্ত্রণ করে ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় রাখতে হবে।
১৪। শরীরের সামর্থ্য বুঝে তাওয়াফ করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাঁটাহাঁটি করবেন না।
১৫। পাতলা পায়খানা বা পেট খারাপ হলে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সহজে হজম হয় না এমন খাবার থেকে বিরত থাকুন। পাতলা পায়খানায় প্রচুর পানি ও ওরাল সেলাইন পান করুন। প্রয়োজনে হজ্জ্ব মেডিকেল ক্যাম্পের ডাক্তারের পরামর্শ নিন। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য/পাইলস/হেমরয়েড আছে বা হয়েছে, মাংস জাতীয় খাবার পরিহার করুন।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ঃ-
১৬। হজ্জ্বের সময় রক্তে গ্লুকোজ কমে যেতে পারে। অতিরিক্ত হাঁটার কারণে ও পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ইনসুলিন দ্রুত রক্তে মিশে যায়। আবার অনেক সময় খাবারের রুটিন মেনে চলা সম্ভব হয় না। এসব কারণে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাই সাথে কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ পানীয়, দুধ, ফলের রস বা চিনির সরবত রাখতে হবে।
১৭। উষ্ণ আবহাওয়ার শরীরে ইনসুলিন সঞ্চিত থাকে কম। এ কারণে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে প্রচুর ঘাম ও পানি শূন্যতার সৃষ্টি হয় যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া এ সময় অনেকে খেজুরসহ নানা মিষ্টি জাতীয় ফল খান, সময়মত ইনসুলিন নেন না। ভুল ধারণায় অনেক ইনসুলিন নেয়া ছেড়ে দেন, কেউ ভুলে যান। ফলে গ্লুকোজের মাত্রাজনিত জটিলতা সৃষ্টি হয়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সবসময় বেশি থাকলে বা প্রসাব ও রক্তে কিটোন নামক রাসায়নিক পদার্থ উপস্থিত থাকলে অবশ্যই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
১৮। যাঁরা ইনসুলিন নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁদের ইনসুলিনের মাত্রা কমানো বাড়ানো প্রয়োজন হতে পারে। যার জন্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে এবং গ্লুকোজের মাত্রা অনুযায়ী ইনসুলিনের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
১৯। ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ইনসুলিন সংরক্ষণ করুন। রোধ থেকে দূরে রাখুন। ইনসুলিন হাতের লাগেজে রাখুন। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখবেন না। রক্ত পরীক্ষার স্ট্রিপ ও ডায়াবেটিস মনিটরটি যাতে রোদের স্পর্শে না আসে সে বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।