আমার সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি আমোদে

 

।। ড. আলী হোসেন চৌধুরী ।।

আমোদ-এর কথা মনে হলেই স্মৃতি আমোদিত হয়। অপূর্ব এক দ্যোতনা খেলা করে। স্থির চিত্রপট সম্মুখে দুলিয়ে যায় হেলিয়ে যায়। ভালো লাগে সেই আমোদ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র আজো বেঁচে আছে। আজো টিকে আছে আপন গৌরবে সৌরভে। সংবাদপত্র বিবেচনায় আমোদ দেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র। এটা কুমিল্লাবাসী হিসেবে শ্লাঘার বিষয়। আবার যখন কৈশোরকালের কথা মনে হয় তখন বড় বেশি পুলক অনুভব করি। কারণ শৈশবেই আমি আমোদের সাথে যুক্ত হয়ে ছিলাম এটা ভাবতেই খুব আনন্দবোধ করি।
তখন আমি ইউসুফ হাই স্কুলের ছাত্র। সম্ভব নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি একটি সংবাদ লিখে আমোদ কার্যালয়ে যাই। অনুমতি নিয়ে ভয়ে ভয়ে কার্যালয়ে প্রবেশ করি। সংবাদটি ছিলো আমার প্রয়াত বন্ধু মুকুলকে নিয়ে। মুকুল ছিলো আমার এক বছরের ছোট অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। বয়সে খানিক ছোট হলেও মাখামাখি ছিলো খুব। একটা আন্তরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম এক সাথে চলাফেরা, খেলাধুলা, দুষ্টুমি ঘুরে বেড়ানো সব মিলিয়ে দৃঢ় একটা ভালোবাসার বন্ধন। মুকুলের পিতা মনসুর আহমেদ সাহেব ছিলেন সেই সময় শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। একদিন দুপুরে বেল পাড়তে গাছের উঁচু ডালে ওঠেছিলো। সেখান থেকে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়েছিলো। কৈশোর জীবনের প্রথম এত বড় আঘাত পেয়েছিলাম। যার জন্য খুব কেঁদেছিলাম। আপনজন হারানোর কষ্টটা তখন বুঝেছিলাম। মুকুল আমাদের সাথেই ফুটবল খেলতো মৌলভী পাড়া মাঠে। বড়দের সহযোগিতায় বন্ধুরা মিলে মুকুলের স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলাম আমরা।
‘মুকুল স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট’ শিরোনামে সংবাদ আমোদে প্রকাশিত হয়। সাংবাদিকতা কি? সংবাদ কিভাবে লিখতে হয়। তার কিছুই জানতাম না। গাইড লাইন ছিল ইত্তেকাফের কচি কাঁচা আসরে কচি কাঁচাদের বিভিন্ন প্রকাশিত সংবাদ দেখতাম। তাছাড়াও অন্যান্য সংবাদ কিভাবে লেখা হয় তা দেখেই একটা আইডিয়া করি সংবাদ লিখে সেই নিয়ে সংবাদ আমোদে গিয়েছিলাম।
একজন ভদ্রলোক আমাকে বসালেন। দুয়েকটা বানান ঠিক করে দিলেন। সংবাদ লেখা নিয়ে কিছু কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটাই সাংবাদিকতার সম্পর্কে জানা বা শিখা। পরে জেনেছিলাম উনি রাব্বী সাহেব। সাংবাদিকতার প্রথম গুরুই আমার জনাব ফজলে রাব্বী। তার ভদ্র ব্যবহার উৎসাহ বাক্যসমূহ আমাকে প্রাণিত করেছিল। সংবাদ লেখার বিষয়ে তার উপদেশ পরামর্শ সাংবাদিকতা প্রথম প্রণোদনা। পরে বুঝছি সামান্য একটা স্কুলের ছাত্র এভাবে সংবাদ লিখছে তাকেও হয়তো আনন্দিত করেছিল। তাই তিনি উৎসাহ দিয়েছেন। তারপর স্কুলের ছাত্র অবস্থায় আরো দুই তিনটি সংবাদ লিখেছি, যা আমোদে প্রকাশিত হয়। তার একটির কথা মনে আছে। ‘মাওলানা আকরাম খাঁর মৃত্যুতে ইউসুফ হাই স্কুলে শোক সভা।’ বাকি সংবাদ গুলোর কথা মনে নেই, তবে ইউসুফ হাই স্কুলেরই কোন সংবাদ হবে।
রাব্বী সাহেবের অনুপ্রেরণায় তখন উজ্জীবিত হই। তখন জেলা পরিষদ থেকে প্রকাশিত হতো পাক্ষিক লালমাই। সেই পত্রিকাতেও সংবাদ দেই মাঝে মাধ্যে। সেখানে পরিচয় হয় সম্পাদক জনাব আতিকুর রহমানের সাথে। পরে ঢাকা অবজারভারের সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় আমৃত্যু কাজ করেছেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার কাছেও সংবাদ লেখার উপদেশ পরামর্শ পেয়েছি। সেই স্কুল জীবনে উদ্দীপিত হয়েছিলাম। তখন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ কুমিল্লা সংবাদদাতা নিয়োগ করবে জেনে আবেদন করি। দৈনিক আওয়াজ কুমিল্লা প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেয়। এটাও ছিল এক উত্তেজনাকর ব্যাপার। অর্থাৎ একটা কথা নির্দিষ্টভাবে বলা যায়- আমোদ আমাকে সাংবাদিকতার কলমটা ধরিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে এ কলমটা আমাকে চালিয়ে নিয়ে গেছে দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারের কুমিল্লা প্রতিনিধি হিসেবে। ঢাকায় দৈনিক আজকের কাগজে ডেক্স এডিটর, দৈনিক আমাদের সময়ের ডেপুটি এডিটর, সর্বশেষ দৈনিক আমাদের কুমিল্লার সম্পাদক। তারপর সাংবাদিকতার ইতি টানি।
সুতরাং এ কথাটি নিঃসংকোচে বলা যায়। আমার ভেতরের সাংবাদিক সত্বাকে জাগিয়ে দিয়েছিল হয়তো বা সৃষ্টি করেছিল আমোদ। সাংবাদিকতার জীবনেও আমোদের সাথে সম্পর্ক ছিল। সংবাদ কিংবা লেখা প্রকাশিত হতো। শ্রদ্ধেয় ফজলের রাব্বী সাহেবের সাথে নানা ভাবে নানা কাজে যুক্ত ছিলাম। ফলে এই মানুষটির সান্নিধ্যে পেয়েছি, ভালোবাসা পেয়েছি। এই পরিবারটির সাথে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হয়। মিসেস শামসুন্নাহার রাব্বী, আকিলা রাব্বী, বাকীন রাব্বী, ফাহমিদা রাব্বী, তারিকা রাব্বী সবাই সাংবাদিক হয়ে ওঠে। পুরো পরিবার সাংবাদিক।
পারিবারিক সংবাদপত্র খ্যাত হয়। তাদের কর্ম চাঞ্চল্য ও কর্ম প্রভায়। আজ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি জনাব ফজলে রাব্বী, মিসেস শামসুন্নাহার রাব্বীকে। আমোদ ইতিহাসের একটি অধ্যায়। কালের যাত্রা পথে সময়ের চিত্র ধারণ করে আছে।
লেখক:শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক।