করোনার দ্বিতীয় ধাপে সচেতনতায় ভাটা 

           দীর্ঘ ৯ মাস পর করোনার নতুন ধরন পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যার মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তন সাধারণ কোভিডের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি গতিতে সংক্রমণ ছড়ায়। ভয়ংকর এই স্ট্রেইনটির সঙ্গে বাংলাদেশের করোনার মিল রয়েছে বলে দাবি করছেন দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। এমন পরিস্থিতিতে করোনার নতুন প্রজাতি ও শীতকালীন দ্বিতীয় ঢেউ রোধে আরও বেশি সচেতনতার দরকার হলেও উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। ফলে যে কোনো মুহূর্তে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি আরও বেশি মারাত্মক হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন বিশেজ্ঞরা। করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে দেশে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে করোনা আক্রান্ত নতুন রোগী বেড়েছিল ৩০ শতাংশ।
অক্টোবরে ভাইরাসটিতে ৬৭২ জনের মৃত্যু হলেও নভেম্বরে এই সংখ্যা বেড়ে ৭২১ জনে দাঁড়ায়। আক্রান্ত বৃদ্ধির পাশাপাশি অক্টোবরের তুলনায় গতমাসে মৃত্যু বেড়েছিল ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি ডিসেম্বরে করোনা সংক্রমণের ২৯২ দিনে (বৃহস্পতিবার) মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭ হাজার ৩৭৮ জনে দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও) তথ্য অনুযায়ী দেশে দুই হাজারের বেশি মানুষ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে। কিন্তু গত ৯ মাসে ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাসে এত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মারা গেলেও দিন দিন সচেতনায় ভাটা পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনার প্রকোপ মোকাবিলায় শুরু থেকেই সাধারণ মানুষ সরকারের জোর প্রস্তুতির অভাব রয়েছে বলে দোষারোপ করছে।

 

কিন্তু সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর থেকেই সরকার ভাইরাসটি প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। উল্টো শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা দেখা গেলেও বর্তমানে সরকারি-বেসরকারিভাবে নেওয়া শত উদ্যোগ সত্ত্বেও ক্রমেই তা উপেক্ষিত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শীতকালীন প্রকোপ বা করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রাণঘাতী ভাইরাসটির সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। এরপরও অধিকাংশ মানুষ তা আমলেই নিচ্ছে না। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, মার্কেট ও গণপরিবহণে মাস্ক পরিধান না করেই অধিকাংশ মানুষ চলাচল করছে। অনেকে নামকাওয়াস্ত মাস্ক ব্যবহার করছে। এ জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা ও সতর্ক করলেও টনক নড়ছে না। বাংলাদেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীসহ দেশের ১১ জেলায় জনসংখ্যা বিবেচনায় করোনায় আক্রান্তের হার প্রতি ১০ লাখে দুই হাজারের বেশি। এর মধ্যে রাজধানীতেই প্রতি ১০ লাখে ৩৪ হাজার ৬৮৮ জন আক্রান্ত।

 

সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ফরিদপুর ও চট্টগ্রামেই প্রতি ১০ লাখে আক্রান্তের হার ৩ হাজারের বেশি। বাকি আট জেলায় আক্রান্তর হার দুই হাজার থেকে ৩ হাজারের মধ্যে। এর বাইরে ২২টি জেলায় আক্রান্তেরর হার প্রতি ১০ লাখে ১ থেকে ২ হাজারের মধ্যে। অথচ এর মধ্যেই দেশে ১৫০ পৌরসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কয়েকদিন দেশে করোনা পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্তের হার কিছুটা কমলেও মৃত্যু  কমছে না। বরং এখনো দৈনিক মৃত্যুর  গড় ৩০ ঘরে রয়েছে। আবার এর মধ্যেই যুক্তরাজ্যে দেখা দেওয়া করোনার নতুন স্ট্রেইনের সঙ্গে দেশের করোনার সঙ্গে মিল রয়েছে বলা হচ্ছে। যা পূর্বের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি গতিতে সংক্রামণ ছড়ায় গবেষকরা জানিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ হয়নি বলে জানা গেছে। একাধিক বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও রোগতত্ত্ববিদ বলেন, যুক্তরাজ্যে দেখা দেওয়া নতুন স্ট্রেইনটি বাংলাদেশের করোনার সঙ্গে মিল রয়েছে। তা ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশী আসার মাধ্যমে যে কোনো সময় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাঠপর্যায়ে সচেতনতায় ভাটায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর  লাগাম টানা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক  বলেন, সংক্রমণ ঠেকাতে ভ্যাকসিনের চেয়ে পিপিই বা মাস্ক পরিধান করা বেশি কার্যকর। যতদিন ভ্যাকসিন না আসে ততদিন মুখে মাস্ক পরিধান, তথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া উপায় নেই। কিন্ত বেশিরভাগ মানুষ পরামর্শ না মেনে ভ্যাকসিনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কোন দেশ ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছে, কোন দেশ উৎপাদনে এগিয়ে আছে, ভ্যাকসিন কেনার ব্যাপারে সরকার কী করছে ইত্যাদি নিয়ে খোঁজখবর রাখছে। কিন্তু ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত এবং ভ্যাকসিন আসার পরও যে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ রোধ এবং পরিস্থিতির উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার দেশের সাধারণ মানুষের চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ৩০ জুনের পর থেকে না বাড়িয়ে কয়েকটি শর্তে স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১ জুলাই থেকে সরকারি অফিস-আদালত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শর্তগুলোর মধ্যে  উল্লেখযোগ্য   ছিল, বাজার, শপিংমল, দোকানপাট রাত ৮টার মধ্যে এবং মহল্লার  দোকানপাট রাত ১০টার মধ্যে বন্ধ করা। মাস্ক ছাড়া শপিংমলে প্রবেশ করতে না দেওয়া। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না আসা। জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ছিল উল্লেখযোগ্য  । একইসঙ্গে সব ধরনের যানবাহনে দাঁড়ানো যাত্রী বহন না করা এবং চালক, হেলপারসহ যাত্রীদের অবশ্যই মাস্ক পরা ও হাত সেনিটাইজ করার ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এসব বাস্তবায়ন ভাটা পড়ছে। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য ১২ দফা নির্দেশনা তথা, অফিস চালুর আগে প্রতিটি কক্ষ, আঙিনা, রাস্তা জীবাণুমুক্ত করা, প্রবেশপথে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা, অফিস পরিবহণ জীবাণুমুক্ত করা, যানবাহনে বসার সময়  ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা ও সার্বক্ষণিক মাস্ক ব্যবহার করা, দৃশ্যমান একাধিক স্থানে ছবিসহ স্বাস্থ্যসুরক্ষা নির্দেশনা ঝুলিয়ে রাখা এবং অসুস্থ কর্মচারীকে তাৎক্ষণিক আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করাও ছিল নির্দেশনায়। ভিজিলেন্স টিমের কাজ ছিল এসব নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা দেখা। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানে এ নির্দেশনা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের কোথাও শপিংমল রাত ৮টায় বন্ধ হচ্ছে না।
মহল্লার  দোকানপাট খোলা থাকছে মধ্যরাত পর্যন্ত। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহারের দৃশ্যও এখন বিরল। অনেকে নামকাওয়াস্ত মাস্ক পরিধানের নামে পকেট বা থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, করোনার মধ্যে জনজীবনে ছন্দ ফেরাতে সরকার শর্তসাপেক্ষে অনেক কিছু চালুর অনুমতি দিয়েছে। এ জন্য নো মাস্ক নো সার্ভিস চালু করেছে, কিন্তু নিঃশর্তেই স্বাভাবিক হয়ে আছে যাবতীয় চলাফেরা। সাধারণ মানুষের খামখেয়ালি চলাফেরা চলতে থাকলেও চলতি শীতের যে কোনো সময় ভাইরাসটিরে গতিবিধি বেড়ে মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। ফলে জনসাধারণকে আরও সচেতন হওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি পালনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সব স্তরকে আরো গুরুত্বসহকারে কাজে মনোযোগী হওয়া জরুরী।
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট, বুড়িচং- কুমিল্লা।