শৈশব- কৈশোরের ঈদ স্মৃতি
।। খায়রুল আহসান মানিক ।।
প্রত্যেক মানুষের শৈশব – কৈশরের ঈদের দিন গুলোর স্মৃতি সারা জীবন নাড়া দেয়। সেই ঈদের দিনগুলো এখনকার সময়ের মতো না হলেও এখনো মনে জেগে ওঠে। বাবার মৃত্যুর পর শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসতে হয়েছিল আমাদের। গ্রামীণ জীবনে তেমন কোন আনন্দ – উল্লাস ছিলনা। বছরে দু’টি ঈদ খানিকটা হলেও আনন্দ নিয়ে আসতো। আমরা বছর ধরে দু’টি ঈদের অপেক্ষায় থাকতাম। রোজার মাস আসলে চাঁদ দেখা নিয়ে বাড়ির ছোট ছেলে – মেয়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো। কে কার আগে চাঁদ দেখতে পাবে। এটাতেও ছিলো আনন্দ। প্রথম দিন চাঁদ দেখা না গেলে মন খারাপ হয়ে যেতো। পরদিনও একই প্রতিযোগিতা চলতো। রোজার ২৯ দিনে আবার ঈদের চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা। চাঁদের দেখা না পেলে আবার মন খারাপ হতো। ঈদটা পেছালো বলে। মন বলতো ঈদটা হয়ে গেলে ভালো হতো। বাবা না থাকায় আর্থিক সংকট ছিল। তাই প্রতি ঈদে নতুন কাপড় পাওয়া যেতোনা। বড় বোন আগ থেকে আমাদের তিন ভাইয়ের কাপড় ধুয়ে রাখতেন। ঘরে বাবার সময়ের একটা ইস্ত্রি ছিল, কয়লা জ্বালিয়ে ধোয়া কাপড় ইস্ত্রি করা হতো। ঈদের চাঁদ দেখা রাতে ঘুমটা কম হতো। রাত শেষ হলেই ঈদ এ নিয়ে উত্তেজনা কাজ করতো মনে। তিন ভাই মিলে ঈদের দিন খুব ভোরে উঠে যেতাম। পুকুরে গিয়ে ভালোভাবে গোসল করে কাপড় পরে নিতাম। ঘরে সুগন্ধি থাকলে হাতে মুখে মাখতাম। ঘরের ড্রেসিং টেবিলে নিজকে কেমন লাগে দেখতাম। বাবার কেনা সেমাই মেশিনে আম্মা ও আমরা মিলে ময়দা দিয়ে বানানো সেমাই ও ফিরনি রান্না হতো। সেমাই ও ফিরনি খেয়ে ঈদের জামাতে রওয়ানা হতাম। ঈদগাহ বাড়ি থেকে পৌনে এক কিলোমিটার দূরে অন্য গ্রামে। দাদা, তার পাঁচ ছেলে ও তার নাতিরা এক সাথে ঈদের জামাতে যেতাম। সাথে থাকতো নামাজ পড়ার জন্য শীতল পাটি ও বিছানা চাদর। তিনি চাইতেন ঈদে জামাতের প্রথম সারিতে নামাজ আদায় করতে। আমরা আগে – ভাগে গিয়ে প্রথম সারিতে বসতাম। নামাজ শেষে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতাম।
তখনও ঈদের দিনে মুরুব্বিদের সালাম করলে সালামি দেওয়া হতো। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল চাচারা তাদের সন্তানদের সালামী দিতেন। কিন্তু আমাদের বাবা না থাকায় সালামী পেতাম না। চাচা- চাচীরাও দিতেন না। বিধবা মা যা দিতে পারতেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট থাকতাম।
শৈশবের সময়টাতে গ্রামের বেশীর ভাগ পরিবারের আয় – রোজগার তেমন ছিল না। সামান্য কৃষি কাজ করে, অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ঈদে সেমাই- চিনি কেনার সামর্থ তাদের ছিলনা। ঈদে আমাদের বাড়িতে গ্রামের লোকজন দাদাসহ অন্যান্য মুরুব্বিদের সালাম করতে আসতেন। তাদের সেমাই ও ফিরনি খেতে দেয়া হতো। এগুলো খেয়ে তারা খুশি মনে ঘরে ফিরতেন। গ্রামীণ খেলাধুলা করা ছাড়া এ দিনে আমাদের আর কোন আনন্দের ব্যবস্থা ছিলনা।
কুরবানির ঈদের বড় আনন্দ ছিল গরু কিনতে যাওয়া। স্থানীয় চিওড়া বাজারে বড়দের সাথে গরু কিনতে যেতাম। এখনকার মতো তখন মোটা – তাজা গরু বিক্রি হতোনা। হাল চাষে ব্যবহৃত গরুই বিক্রি হতো, কুরবানির জন্য। আমাদের ছয় পরিবারের জন্য একটা গরু কেনা হতো। গরু কেনার পর আমরা সবাই মিলে দড়ি টেনে বাড়ি আনতাম। কুরবানির দিন পর্যন্ত চলতো গরুর সেবা যত্ন। এ কাজে মজাও পেতাম। বাড়ির কাজের লোকসহ আমরা সবাই জবাই করা গরু কাটাকুটিতে লেগে যেতাম। কাজ শেষে যার যার ঘরে গোশত নিয়ে যেতাম। তারপর গোশতের তিন ভাগের এক ভাগ গ্রামে কুরবানি না দেয়া পরিবার গুলোর ঘরে ঘরে পৌঁছাতাম। যারা সে সময় কুরবানি দিতে পারতেন না এখন তাদের পরিবারের অনেকেই স্বচ্ছল। একাই একটা গরু কুরবানি দিচ্ছে এখন। কুরবানি ঈদে আমাদের জন্য অন্য মজাও ছিল। গরু জবাইয়ের পর ভুড়ির চামড়া দিয়ে ঢোল বানাতাম। মাটির হাড়ি বা পাতিলের মুখে সেই চামড়া লাগিয়ে শুকিয়ে বানানো ঢোল ছিল সেই ঈদের আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ।
শৈশব Ñ কৈশরের পরে অনেক ঈদইতো পার হয়েছে। এখনকার ছেলে – মেয়েদের ঈদের মজাই অন্যরকম। পার্কসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঈদের বিকেল ও সন্ধ্যা কাটে তাদের। তাদের আনন্দ দেখে নিজেরও আনন্দ হয়। আর মনে পড়ে আমার শৈশব- কৈশরের ঈদ দিন গুলোর স্মৃতি। যা এখনও মনে আনন্দ দেয়। স্মৃতি জাগানিয়া সে সময় গুলো কখনো ভুলা যাবেনা। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
লেখক:সাংবাদিক।