সিরাজ থেকে ইউনূস: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
“ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা গ্রহণ করি না।” ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অন্ধকার যুগের সূচনা ঘটে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেই বিশ্বাসঘাতকতার কুশীলব ছিলেন মীর জাফর, জগৎ শেঠ, ও কিছু অভিজাত শ্রেণির স্বার্থান্ধ মানুষ—যারা ব্যক্তিস্বার্থে জাতিকে বিকিয়ে দেন।
সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক দখলদারিত্ব ও সাম্রাজ্যবাদী প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। কিন্তু তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর জাফর, ধনকুবের জগৎ শেঠ এবং কিছু নবাবি সভাসদ ব্রিটিশদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে সিরাজের পতন ঘটান।
ফলস্বরূপ, পলাশীর যুদ্ধে নবাব বাহিনী মুখ থুবড়ে পড়ে এবং বাংলার স্বাধীনতা কোম্পানির খাঁচায় বন্দী হয়ে যায়। ইতিহাসে মীর জাফরের নাম চিহ্নিত হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি : আধুনিক সময়ের ‘সিরাজ’?
২০২৪ সালের আগস্টে, এক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনমেয়াদের অবসান ঘটে। এর প্রেক্ষিতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত সমাজ-উদ্যোক্তা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ঘোষণা দেন, একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন।
কিন্তু সময় যত গড়ায়, তার চারপাশে ষড়যন্ত্রের মেঘ ঘনীভূত হতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন, সামরিক বাহিনীর অসন্তোষ এবং ভারতের কিছু গোষ্ঠীর চাপ—সব মিলিয়ে তার অবস্থান ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে ওঠে।
বিশেষ করে ২০২৬ সালের জুনে নির্ধারিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও সেনা নেতৃত্বের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দেয়। অনেকেই মনে করেন, এই সংকটের আড়ালেও কিছু ‘মীর জাফর’ লুকিয়ে আছে—যারা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে জাতীয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে প্রস্তুত।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ
ড. ইউনূসের ওপর ভারতের কিছু মহলের বহুদিনের অসন্তোষ অজানা নয়। তার ব্যাংকিং ও সামাজিক উদ্যোগ বারবার আঘাত পেয়েছে দেশের ভেতরের প্রভাবশালী কিছু মহলের কারণে। এই চক্রগুলো এখন আরও সক্রিয়। পশ্চিমা বিশ্ব যদিও তাঁকে নীতিগতভাবে সমর্থন করে, তথাপি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায়, তাদের সমর্থন কতটা দৃঢ়—তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
ইতিহাসের শিক্ষা কী?
পলাশীর যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল—অভ্যন্তরীণ ঐক্যের অভাব ও বিশ্বাসঘাতকতা একটি জাতিকে কত বড় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। আজ, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা দেখি একই চিত্র—স্বার্থান্ধ দলাদলি, বহিরাগত প্রভাব, এবং নেতৃত্বহীনতার সংকট।
যদি ড. ইউনূস সত্যিকার অর্থে একজন দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রপন্থী নেতা হন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বর্তমান ষড়যন্ত্রমূলক পরিস্থিতি এক ভয়াবহ পুনরাবৃত্তির ইঙ্গিত দেয়। সিরাজের মতো, তিনিও যদি অভ্যন্তরীণ মীরজাফরদের হাতে প্রতারিত হন, তবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
বাংলাদেশের সামনে আজ এক সন্ধিক্ষণ। ইতিহাস আমাদের বারবার সতর্ক করেছে—জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিলে তার মূল্য দিতে হয় দীর্ঘমেয়াদে। সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর যেমন বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিল প্রায় দুই শতক ধরে, তেমনি আজকের ভুলও হতে পারে ভবিষ্যতের দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের সূচনা।
এখনই সময়, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে ইতিহাসের এই চক্রবৎ পুনরাবৃত্তি রোধ করার।
তথ্যসূত্র:
কালি প্রসন্ন সিংহ, পলাশীর যুদ্ধ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, Creating a World Without Poverty, PublicAffairs, 2008
The Daily Star, August 2024 Reports on Interim Government
BBC News, South Asia Politics Archive, 2024-2025
অ্যানি পল, বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতা, বঙ্গীয় গবেষণা সংসদ।
