সংরক্ষিত হোক তাদের কর্মযজ্ঞের প্রামাণ্য ইতিহাস

প্রবীর বিকাশ সরকার
আমার একটি দোষ এই যে, প্রিয়জন কেউ ইহলোক ত্যাগ করলে দ্রুত শোক কাটিয়ে উঠতে পারি না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি ঠিকই তাতে করে মনের আকুতি শান্ত হয় না। পরে কিছু লেখার মাধ্যমে স্মরণ করি। গত শুক্রবার ২৫ জুন প্রয়াত হয়েছেন কুমিল্লার মুখ বেগম শামসুননাহার রাব্বী, তাঁর স্মরণে আমার কিছু কথা।
আবাল্য প্রিয় কুমিল্লা শহর আমার জীবনে কী জিনিস সে একমাত্র আমি এবং আমার বিধাতাই জ্ঞাত। এই শহরের মানুষ, স্থাপত্য, প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। মানুষের কথাই যদি বলি, বাল্যকাল থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত অনেক খ্যাতিমান কুমিল্লাবাসীর সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ধমর্ বর্ণ কর্ম আদর্শ ব্যতিরেকে।

inside post

তেমনি একজন মানুষ ছিলেন বেগম শামসুননাহার রাব্বী। যাঁকে আমি খালাম্মা বলে সম্বোধন করতাম প্রধানত দুটি কারণে, এক, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আলাওল হলের কক্ষসঙ্গী বাগিচাগাঁও এর অধিবাসী আহম্মদ আলী মিটনের আত্মীয় মঞ্জুখালা তিনি। দুই, “আমোদ পরিবারে”র সন্তান বর্তমানে পত্রিকার সম্পাদক বাকীন রাব্বী আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু।

বেগম শামসুননাহার রাব্বী তথা খালাম্মাকে দেখে এসেছি আমি ১৯৬৯ সাল থেকে যতখানি মনে পড়ে। সুস্পষ্টভাবে মনে পড়ে যখন পুরাতন চৌধুরীপাড়া প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র তখন থেকে। এরপর কুমিল্লা হাই স্কুলের ছাত্রকালীন তাঁকে দেখেছি, ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে যখন জাপানে চলে আসি তার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত খালাম্মাকে “আমোদ” ভবনে দেখেছি।

আমোদ পত্রিকার অফিস পুরাতন চৌধুরীপাড়ার যে মোড়ে অবস্থিত, সেই মোড়ে গেলেই প্রেসের খটাখট-ঝিকঝাক এই ধরনের অনুচ্চ শব্দ কানে বাজত। দৃষ্টিনন্দন ভবনের ফটকের পাশেই রয়েছে পত্রিকার নোটিশ বোর্ড, সেখানেই দাঁড়িয়ে ছাত্রজীবনে সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকা পাঠ করেছি। মাঝে মাঝে দেখেছি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফজলে রাব্বী সাহেবসহ খালাম্মাকে প্রেসের ভেতরে কাজ করতে। দুজনেই ছিলেন বিপুল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমি এবং সহপাঠী বন্ধুরা চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না, সম্ভ্রমের সঙ্গে দৃষ্টি নামিয়ে নিতাম যদি কখনো চোখাচোখি হয়ে যেত।
সাপ্তাহিক “আমোদ” শুধু একটি পত্রিকাই নয়, সারা বিশ্বে বাংলাদেশ তথা কুমিল্লার গৌরবকে উপস্থাপন করে আসছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। এটা বালসুলভ ব্যাপার নয় আদৌ। এর পেছনে যে দুজন মানুষ চিন্তা, দর্শন, আদর্শ থেকে নিরলস শ্রম দিয়ে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে তার তুলনা এই যুগে এককথায় বিরল, আর এই দুজন হলেন এই শহরের প্রাতঃস্মরণীয় নমস্য সাংবাদিক দম্পতি জনাব ফজলে রাব্বী এবং বেগম শামসুননাহার রাব্বী।
আমি যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন একটি ছড়া ডাকে পাঠিয়েছিলাম। সেটা ছাপা হওয়ার পর এই প্রথম আমোদ ভবনে বন্ধু স্বপন সেনগুপ্তসহ গিয়েছিলাম সম্পাদক রাব্বী সাহেবকে ধন্যবাদ জানানো এবং সৌজন্য কপি পাওয়ার জন্য। পরিচয় দেবার পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটি কপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, “অভিনন্দন।
তোমার লেখার হাত ভালো, লিখে যাও।” সেই আশীর্বাদ আজও আমাকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করে। সেদিনও আমি তাঁর পাশে খালাম্মাকে দেখেছিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলেন, সেই সুশ্রী হাসি এবং তাঁর অনিন্দ্য সৌন্দর্য শুধু আমার কাছেই নয়, কুমিল্লা শহরের মানুষের কাছে সুপরিচিত ও অবিস্মরণীয় বলেই বিশ্বাস করি। তখনও তাঁদের সুযোগ্য সন্তান বাকীন রাব্বীকে বহুবার দেখলেও পরিচয় ছিল না ।
“আমোদ” শুধুমাত্র একটি পত্রিকাই নয়, একটি প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের স্মৃতি। কুমিল্লার প্রধান সাংবাদিক আজকে যারা দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের অনেকেই এই পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাঠ নিয়েছেন, কাজ করেছেন এবং লেখালেখি করেছেন।
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফজলে রাব্বী যখন ইহলোক ত্যাগ করলেন তারপর পত্রিকার হাল ধরেছিলেন শক্তভাবেই বেগম রাব্বী। ক্রমেক্রমে উত্তরাধিকারী বাকীন রাব্বীকে সুযোগ্য করে তুলেছেন। বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বেই এমন ঘটনা ঘটেছে খুবই কম। তবে কুমিল্লার প্রাচীন কাগজ “ত্রিপুরা হিতৈষী”র সম্পাদক কমনীয় সিংহ রায় দেহত্যাগ করার পর তাঁর সহধর্মিণী ঊর্মিলা সিংহ রায় কর্তৃক সম্পাদনার হাল ধরার ইতিহাস রয়েছে। এটাই কুমিল্লার সংবাদপত্রের সুমহান ঐতিহ্য।

স্বল্পভাষী এবং প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্না বেগম শামসুননাহার রাব্বীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছে ২০১৩ সালের দিকে ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদ তথা জিয়াকাকার কল্যাণে। এর বছর দুয়েক আগে পরিচয় হয় জিয়াকাকার মাধ্যমেই বাকীন রাব্বীর সঙ্গে, তখন সে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মনে হয়। জাপান থেকে কুমিল্লায় যাওয়া-আসার মধ্যে জিয়াকাকার সঙ্গে বেশ কয়েকবার গিয়েছি আমোদ ভবনে এবং দীর্ঘ ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি। খালাম্মার সঙ্গেও সম্ভাষণ ও কুশল বিনিময় হয়েছে। একাধিক লেখা প্রকাশ করেছেন তিনি আমার। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

“আমোদ” পত্রিকা কুমিল্লা শহরের শুধু ঐতিহ্যই নয়, আমোদ পরিবারও আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এই পরিবারের সঙ্গে অনেক আত্মীয়-অনাত্মীয় সাংবাদিক জড়িত নানাভাবে। “আমোদ” কুমিল্লাসহ সারা বাংলাদেশের অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ। জানি না, বাংলাদেশ সরকার আজ পর্যন্ত সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকাটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেছে কি না? না করে থাকলে অনতিবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক এবং একইসঙ্গে কুমিল্লার আরও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকে মূল্যায়ন করা জরুরি।

কুমিল্লা শহরে নগর জাদুঘর গড়ে ওঠার কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে সসম্মানে সংরক্ষিত হোক সাপ্তাহিক আমোদ, এর প্রতিষ্ঠাতা ফজলে রাব্বী ও বেগম রাব্বীর প্রতিকৃতি। তাদের কর্মযজ্ঞের প্রামাণ্য ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানা প্রয়োজন।
মফস্বল সাংবাদিক জগতের অনন্য নারী সাংবাদিক ও সম্পাদক মহীয়সী বেগম শামসুননাহার রাব্বীর পবিত্র স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি প্রার্থনা করছি।

লেখক: জাপান প্রবাসী সাহিত্যিক।

আরো পড়ুন