এক দীর্ঘ দুর্লঙ্ঘ পথপরিক্রমার রেকর্ড


।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ।।
কোন ভণিতা না করেই মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। এ বছর বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং সিলেট জেলার ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা “সাপ্তাহিক আমোদ” প্রতিষ্ঠার একাত্তর বর্ষে পদার্পণ করতে চলেছে। আগামী ০৫ মে। এই শুভক্ষণটিকে তাৎপর্যমন্ডিত ও হৃদয়ের মণিকোঠায় লিপিবদ্ধ বা রেজিস্ট্রার করে রাখবার জন্যে পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ একটা বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করবার উদ্যোগ নেন। সে উদ্যোগে আমারও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার অভিপ্রায়ে পত্রিকাটির তরুণ অথচ তীক্ষœ এবং দূরদর্শী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মহিউদ্দিন মোল্লা গত ১৬ এপ্রিল আমায় ফোনে অনুরোধ করেন একটা লেখা যেন অবশ্যই দিই। ওই শুভ দিনটিকে স্মরণ করবার জন্যে। তিনি পরামর্শও দেন লেখার সাম্ভাব্য বিষয়বস্তু কি হতে পারে।
কেননা বিগত সত্তর বছর ধরে কুমিল্লার গর্ব আমোদ‘কে নিয়ে এমন কোন প্রসঙ্গ নেই যা নিয়ে লেখা হয়নি, তা বলা যাবেনা। তাই, কোন প্রসঙ্গের ওপর লেখাটা হতে পারে জিজ্ঞেস করতেই উদীয়মান সাংবাদিক মহিউদ্দিন মোল্লা আমোদ‘র দীর্ঘ কন্টকাকীর্ণ পথচলার কথা বলেন।
লেখার বিষয়বস্তু বা আইডিয়া তো পাওয়া গেল। কিন্তু ফ্যাসাদ বাধলো কোথা থেকে শুরু করা যায়। তারপর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে নিবন্ধটি টেনে নিয়ে যাওয়া। নিরলস, অবিশ্রাম ও কন্টকাকীর্ণ পথে এতো দীর্ঘসময় ধরে আমোদ‘র পথচলা তো চাট্টিখানি কথা নয়। সম্ভবত: এটা একটা রেকর্ড। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্তত:।
তাছাড়া, আত্মিক ও নীতিগত যোগাযোগ এবং সমর্থন থাকলেও ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি আমোদ একটি পারিবারিক পত্রিকা। যে সাপ্তাহিকীটিতে শহরের পুরানো চৌধুরীপাড়ার একটি অভিজাত ও প্রতিষ্ঠিত নির্বিরোধী পরিবারের সব সদস্যই তাদের শ্রম দিয়েছেন। যে যার অবস্থান থেকে। সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন। একটি সাধারণ বনেদি পরিবারের যা যা টানাপোড়েন থাকে বা অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকে তা সফলভাবে সামনাসামনি মোকাবেলা করে। শত প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতা বা বিড়ম্বনা ডিঙ্গিয়ে পরিবারের সব সদস্যই শ্রম দিয়েছেন যাতে করে পত্রিকাটির প্রকাশনা নিয়মিত থাকে। কোনক্রমেই ব্যাহত না হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে নামটি বা যে ব্যক্তিত্ব আমাদের দৃষ্টিগোচর হন, তিনি আর কেউ নন স্বনামধন্য আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী। সাংবাদিকতায় আমাদের গুরু শিক্ষক, অগ্রজ এবং পথপ্রদর্শক। নেতৃত্ব যদি সঠিক শিক্ষিত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা আর কমিটমেন্ট-এ অবিচল থাকেন, তাহলে যে কোন প্রতিষ্ঠান তা রাজনীতিক দল, সংবাদপত্র, ব্যবসায়ী বা ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান হোক কিংবা কোন সংগঠন অচিরেই গণমানুষের মনে সুগভীর দাগ কাটতে পারে। স্থায়ী ছাপ আঁকতে সক্ষম হয়। কেননা কোন এলাকা বা দেশের মোট জনসংখ্যার একটা গরিষ্ঠ অংশ সেটিকে সমর্থন করে থাকে। পরবর্তীতে তা পছন্দের তালিকায় স্থান দিয়ে গ্রহণ করে অনায়াসে, নির্দ্বিধায় ।
দেশে-বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত সাপ্তাহিক আমোদও সেভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়েছে। প্রকাশনার অল্পকটি বছরেই পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তার নির্দলীয় সম্পাদকীয় নীতি এবং পক্ষপাতহীন নিয়মিত দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশনার খাতিরে। নইলে সত্তর একাত্তর বছর আগে একটি মফস্বল শহর থেকে শুধুমাত্র ক্রীড়া সাপ্তাহিক হিসেবে লেটার প্রেসে ছাপিয়ে আত্মপ্রকাশ করবার পর মাত্র তিন বছরে ১৯৫৮ সালে তা ব্রডশিট সাধারণ সংবাদপত্র হিসেবে উত্তরণ ঘটে। তা অবশ্যই বাহবা বা লিডারশিপ কোয়ালিটি বা নেতৃত্বের গুণ। এটা একদল অভিজ্ঞ-তরুণ সাংবাদিক সমন্বয়ে গঠিত দলবদ্ধ প্রচেষ্টারই সুফল বা অর্জন বলে পরিগণিত হবে সাধারণ জনগণ এবং অভিজ্ঞ ইতিহাসবিদদের কাছে কালক্রমে।
ধান্ধাবাজি, ক্ষমতাসীন দল এবং স্থানীয় প্রশাসনের উমেদারী, চাটুকারিতা এবং পদলেহন না করেও আদর্শিক সাংবাদিকতা যে করা যায়, আর অতি অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাসকে পরিহার করেও যে একটি সংবাদপত্রকে গণমানুষের দোড়গোঁড়ায় পৌঁছানো যায় তা আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক মো ফজলে রাব্বী এবং তাঁর অবর্তমানে বিদুষী সংগ্রামী পরবর্তী সম্পাদক বেগম শামসুন্নাহার রাব্বীর অক্লান্ত পরিশ্রম আর দূরদর্শী নেতৃতে¦র জাজ্জ্যল্যমান প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাইতো আমোদ দেশের একটি অন্যতম সফল আঞ্চলিক সংবাদপত্রের মর্যাদা লাভ করে ১৯৮৫ সালে। সিলেটের অভিজাত এবং একসময়কার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক যুগভেরীর সঙ্গে। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক দ্য এশিয়ান মাস কমিউনিকেশান্স এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (এমিক) এশিয়ার সফল কমিউনিটি সংবাদপত্রের ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে সেসময়। পরবর্তীতে জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এশিয়ার পাঁচ পাঁচটি পত্রিকাকে সেরা সফল আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এমিক। এ পাঁচটি সংবাদপত্রের মধ্যে দুটোই ছিল বাংলাদেশের । একটি কুমিল্লার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক আমোদ। অন্যটি সিলেটের বিপুল জনপ্রিয় সাপ্তাহিক যুগভেরী। আর অন্য তিনটি পত্রিকার মধ্যে ফিলিপাইন, ভারত এবং ইন্দোনেশিয়ার একটি করে পত্রিকা রয়েছে।
ইউনেস্কোর (জাতিসংঘের শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা) হয়ে এমিক এ জরিপ কাজ পরিচালনা করেছিলো। দ্য ফিলিপিনস্-এর রাজধানী ম্যানিলায় অবস্থিত এক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষককে এ জরিপ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁর নাম ড. ক্রিসপিন সি মাসলগ। এমিক এ সংক্রান্ত একটা বইও প্রকাশ করেছিলো সেসময়। ফাইভ সাকসেসফুল এশিয়ান কমিউনিটি নিউজপেপারস্ নামে। সেসময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান এমিক আমাদের গর্ব আমোদ এবং সিলেটের স্বনামখাাত পত্রিকা যুগভেরীকে এই বিরল সম্মানে অভিষিক্ত করেছিলো। যুগভেরী সম্পাদক মরহুম আমিনূর রশিদ চৌধুরী ছিলেন আমাদের রাব্বী ভাই-এর বিশিষ্ট বন্ধু। হ্যাটস্ অফ টু আওয়ার আমোদ এ্যান্ড ইটস ফাউন্ডার রাব্বী ভাই এ্যান্ড অলসো টু যুগভেরী এ্যান্ড ইটস্ ফাউন্ডার-এডিটর।
কখনো সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, কখনো-সখনো সাদা ফুল প্যান্ট-শার্ট পরে হালকা-পাতলা গড়নের আমাদের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই, রাব্বী ভাইকে খবরের সন্ধানে, কাঁধে ইয়াসিকা-ম্যাট বা ইয়াসিকা-ডি রেগুলার ক্যামেরা নিয়ে কুমিল্লার অলিতে-গলিতে ঘুরতে দেখেছি। সেই ষাট-এর দশকের প্রথম ভাগ থেকেই। প্রকাশিত হওয়ার পর নিজ হাতে তাঁর আপন সন্তান সমতুল্য আমোদ পত্রিকা তিনি আগ্রহী পাঠকদের মধ্যে বিলি করতেন। সম্পাদনা ও মুদ্রণ সম্পন্ন হওয়ার পর আমোদ পরিবারের সকলে মিলে প্যাকেট করে যথাযথ পোস্টেজ স্টাম্প লাগিয়ে বড় পোষ্ট আপিসে নয়তো রেলওয়ে পার্সেল শাখায় পাঠাতেন যেন তা পাঠকদের হাতে ঠিক সময়মতো পৌঁছায়। এমনই নিরলস পরিশ্রমেরই ফসল পাঠকপ্রিয় আমোদ তার একাত্তর বছরে পা দিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এবং এ দেশীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে এটি একটি রেকর্ড সম্ভবত:।
গত বছর কুমিল্লা জেলা সদরের নজরুল ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বরেণ্য সব ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত থেকে আমোদ প্রকাশক-সম্পাদক রাব্বী ভাই, পরবর্তী সম্পাদক বেগম শামসুন্নাহার রাব্বী ভাবীর সাদামাটা জীবনযাপন ও সন্তানের মতো আপত্য স্নেহ যত্নে যে আমোদকে লালন পালন করে এতোটা বড় করেছেন তা ব্যক্ত করেন। আলোচনা সভায় রাব্বী ভাই-এর আমেরিকা প্রবাসী তিন মেয়ে আকিলা রাব্বী, ফাহমিদা রাব্বী ও তারিকা রাব্বীও স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখতে গিয়ে আত্মকথন উচ্চারণ করেন।
রাব্বী ভাই যে কতটা সাদাসিধা ছিলেন তা বক্তবের এক পর্যায়ে বলতে গিয়ে ফাহমিদা রাব্বী জানান, আমোদের জন্য বরাদ্দকৃত উদ¦ৃত্ত নিউজপ্রিন্ট সরকারি কর্ণফুলী নিউজপেপার মিলস না যেন খুলনা নিউজপেপার মিলস-এ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রাব্বী ভাই। পেশাগত কতোটা সৎ হলে এবং স্বদেশপ্রেমী কোন ব্যক্তিত্ব ছাড়া এ কাজ কেউ করতে পারেন তা আমার পঁচাত্তর-প্লাস জীবনে দেখিনি বা শুনিওনি । যেখানে ভুয়া বেশি সারকুলেশান দেখিয়ে একধরনের পত্রিকা মালিক রয়েছেন উদ্বৃত্ত নিউজপ্রিন্ট কালোবাজারে বিক্রি করে থাকেন সেখানে রাব্বী ভাই কতোটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একজন সম্পাদক ছিলেন তারই প্রমাণ বহন করে এ ধরনের সিদ্ধান্তে বা কর্মকান্ডে।
প্রকাশনা পলিসি হিসেবে পত্রিকাটিতে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ ও কর্মপন্থা সমুন্নত বেখেছেন রাব্বী দম্পতি এবং তার পরে তাদের একমাত্র ছেলে সম্পাদক বাকীন রাব্বী। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়লো। একবার কোন এক সাংবাদিক স্বামী বিবেকানন্দজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি নাকি সাম্প্রদায়িক? উত্তরে স্বাধীন ভারতের যুব সমাজের পিতা স্বামীজি বলেছিলেন, নিজের ধর্ম প্রতিপালন করবার কারণে কেউ যদি আমায় সাম্প্রদায়িক হিসেবে আখ্যা দেয় বা গণ্য করে, তাহলে আমি ১০০% সাম্প্রদায়িক।
কথাকটা বললাম একটা দু:খবোধ থেকে। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনক হলেও সত্য যে, অধ্যক্ষ আবদুর রৌফ, অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বরেণ্য কবি ছড়াকার জহিরুল হক দুলাল প্রমুখের মতো আওয়ামী লীগ পন্থী নেতা রাব্বী ভাই-এর বিদেশে অবস্থানকালে কিংবা অনুপস্থিতিতে পত্রিকাটির নিয়মিত প্রকাশনা নিশ্চিত করবার জন্য হাল ধরেছেন। তারপরও একদল সমালোচক আমোদকে নিয়ে কুৎসা রটিয়েছে। কিন্তু তারা সম্ভবত: জানেননা বা উদ্দেশ্যমূলক প্রপাগান্ডায় লিপ্ত রয়েছেন। অন্যথায় একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে রাব্বী পরিবার কিভাবে সমূহ বিপদ মাথায় নিয়েও কতজনকে যে ত্রিপুরায় পঠিয়েছেন তার খবর ক’জন রাখে। আমি যদ্দুর জেনেছি তাতে নির্ভয়ে ও উঁচু গলায় বলতে পারি, এদের মধ্যে বেশ ক’জন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন।
কুমিল্লার ও আমাদের গর্বের সংবাদপত্র সাপ্তাহিক আমোদ অন্তত:পক্ষে একশ বছর বেঁচে থেকে আরো একটি মাইলফলক অতিক্রম করুক, প্রত্যাশা করি। এই উপলক্ষ্যে আমোদ পরিবারের সব্বাইকেই ইত্যবসরে হার্দিক শুভেচ্ছা আর শুভকামনা জানাই।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব।
মোবাইল: ০১৭৩১-৫১২৭২২।