স্বপ্নভাঙার শব্দ কি ইতিহাস শোনে?

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
একটা হঠাৎ আসা দমকা হাওয়া যখন চড়ুই পাখির ছোট্ট বাসাটিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, তখন কি শুধুই একটি বাসা নষ্ট হয়? না, নষ্ট হয় একটি পৃথিবী। নষ্ট হয় একফোঁটা নিশ্চিন্তির স্বাদ, একটুকরো নিরাপত্তার ছায়া, নষ্ট হয় একটিমাত্র জীবনের অবলম্বন। প্রকৃতির নিয়মে চড়ুইটি হয়তো ফিরে আসবে, আবার নতুন ঘর বাঁধবে, আবার ডানায় ডানায় বুনবে বেঁচে থাকার গান। কিন্তু সেই প্রথম ভেঙে যাওয়া আশ্রয় আর কোনোদিন আগের মতো হয় না।
ঠিক তেমনি, ইতিহাসও কিছু কিছু মুহূর্তে মানুষের সাজানো স্বপ্নগুলোকে মুছে ফেলে এক নির্মম অধ্যায়ে। একেকটি অভ্যুত্থান, একেকটি বিপ্লব, একেকটি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ছায়ায় হারিয়ে যায় কত শত পরিবার। বুলেটবিদ্ধ কেবল শরীর নয়, রক্তাক্ত হয় ভবিষ্যত। মৃত্যু কেবল একজনের নয়—তার সন্তানদের, তার স্ত্রীর, তার পিতামাতার। এইসব নিহতরা শহীদ, তারা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান পায়, কিন্তু তাদের ঘরবাড়ি, তাদের চোখের জলের দাম, কেউ রাখে কি হিসেব?
জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের পরিবারগুলো কি কেবল স্বজন হারিয়েছে? না, তারা হারিয়েছে অস্তিত্বের মাটি। ভেঙে পড়েছে স্বপ্নের মিনার, নিভে গেছে আলোর প্রদীপ। একদিন যারা সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিল—“আমরা আলো আনব”—তারাই আজ ইতিহাসের প্রান্তে এক নামহীন কান্না। শিশুরা আজও অপেক্ষায় থাকে, বাবা ফিরে আসবে বলে। স্ত্রীরা আজও রাতে স্বপ্নে জেগে উঠে, স্বামীর গলার স্বর যেন ঘরের কোণায় বাজে।
নির্মমতার একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো—এটা কখনো একা আসে না। এটি শুধু একজন মানুষকে মুছে দেয় না, বরং টেনে নিয়ে যায় একটি পরিবারের অস্তিত্ব, একটি গোটা সমাজের আত্মাকে। একজন শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা হয় ইতিহাসের পাতা, আর তার পেছনে ছায়া হয়ে বেঁচে থাকে একগুচ্ছ অভিমান, অজস্র কান্না, আর নিঃসীম অপেক্ষা।
ইতিহাসের গদ্যপটে লেখা থাকে বিজয় কিংবা ব্যর্থতার কাহিনী, কিছু নাম, কিছু পদবি, কিছু তারিখ। কিন্তু সেই পৃষ্ঠায় জায়গা পায় না শহীদ সন্তানদের রাতের ঘুমহীন চোখ, অথবা সেই মায়ের বুকভরা হাহাকার যার কোলে আর ফিরে আসে না ছেলে।
তবু জীবন থেমে থাকে না। মানুষ চড়ুই পাখির মতই আবার ঘর বাঁধে। মাটি কেটে, চোখের জল মুছে, আবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু হারানোর সেই ক্ষরণ কি কোনোদিন থামে? বুকের মাঝে জমে থাকা আর্তনাদ কি নিঃশব্দে চুপিচুপি রক্ত হয়ে ঝরে পড়ে না প্রতিদিন?
তবু এক প্রশ্ন থেকে যায়—এই নির্মমতা কি অনিবার্য ছিল?
এই অভ্যুত্থান, এই মৃত্যুমিছিল, এই অন্ধকার ভবিতব্য কি আমাদেরই তৈরী নয়? মানুষ কি সত্যিই শেখে তার ভুল থেকে? না, আমরা শুধু ইতিহাস পড়ি, ইতিহাস লিখি, ইতিহাসে গৌরব দেখি, অথচ ইতিহাসের কান্না শুনি না।
একটি জাতি তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন সে শুধু বিজয় নয়, ব্যথাকেও স্মরণে রাখে। তখনই আমরা সভ্য, যখন আমরা শুধু রাজপথের পদচারণা নয়, প্রতিটি নিভে যাওয়া ঘরের আলোকে শ্রদ্ধা জানাই। প্রতিটি শহীদের পেছনে যে অনাহারী পরিবার, যে অভিমানী সন্তান, তাদের গল্পগুলোও যেন লেখা হয় আমাদের পাঠ্যপুস্তকে, আমাদের হৃদয়ের মর্মস্থলে।
আর তাই আজকের এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের বলা উচিত—আমরা ভুলে যাব না। আমরা শ্রদ্ধা জানাব সেইসব নিঃশব্দ স্বপ্ন ভাঙার শব্দগুলোকে, যেগুলো হয়তো ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি, কিন্তু আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তি। আমরা স্মরণ করব সেইসব ঘর, যেগুলো চড়ুই পাখির ন্যায় ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা রেখেছে—আবার গড়ে উঠবে।
কারণ, প্রতিটি স্বপ্নের একটি শব্দ আছে, প্রতিটি শব্দের একটি কান্না, আর প্রতিটি কান্নার রয়েছে ইতিহাস।
সেই ইতিহাসই একদিন জিজ্ঞাসা করবে—
এই মৃত্যু, এই কান্না, এই অভ্যুত্থান…
এসব কি সত্যিই অনিবার্য ছিল?
