স্মৃতিতে সাংবাদিকতার সাতকাহন

।। মমিনুল ইসলাম মোল্লা ।।
বড় ভাই মনির মোল্লার নামে ডাক যোগে পত্রিকা আসতো। এলাহাবাদ গ্রামেই ছিল পোস্ট অফিস। যেদিন পত্রিকা আসবে সেদিন উন্মুখ হয়ে থাকতাম। পত্রিকা বিলি করবে সন্তোষ পিয়ন । কিন্তু পিয়নের হাতে আসার আগেই পোস্ট মাস্টার খোকা মিঞার বাড়ি থেকেই তা নিয়ে আসতাম। নতুন পত্রিকাটি কতগুলো ওয়েস্টেজ পত্রিকা দিয়ে গোল করে প্যাচানো থাকতো। নতুন পত্রিকার গন্ধই যেন আলাদা। ভাজ করা প্যাকেটের প্রতিটি ভাজ প্যার প্যার আওয়াজ তুলে খুলতাম আর ভাবতাম ভাইয়ের পাঠানো দেবিদ্ধারের নতুন নতুন সংবাদ পাব। সাথে থাকবে দেশ-বিদেশের সুখ-দ:খের খবর।
পত্রিকা পড়তে পড়তেই পত্রিকার প্রতি আকর্ষণ। সেই থেকে আমিও নিউজ লেখার স্বপ্ন দেখতে থাকি। ভাই বল্ল, এখন নয় সামনে তোর পরীক্ষা। পরীক্ষা মানে এসএসসি পরীক্ষা। বড় ভাইয়ের কথামত অপেক্ষা করলাম। ৮৯ সালের মার্চ মাসে পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই বিভিন্ন পত্রিকায় ডাকযোগে আবেদন করতে থাকলাম। তখন এলাহাবাদ বাজারে একদিন পর দৈনিক পত্রিকা পাওয়া যেত। প্রায় প্রতিটি সেলুনে পত্রিকা রাখতো। ইত্তেফাক পত্রিকায় খুলনা থেকে প্রকাশিত ” সাপ্তাহিক গ্রামাঞ্চল “ পত্রিকায় আবেদন পাঠালে আমাকে ৬ মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে নিউজ পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়। সেই থেকে শুরু। শুরুতে শুধুমাত্র চলতি সংবাদ লিখলেও পরবর্তীতে ফিচার ও বিষয়ভিত্তিক কলাম লেখায় মনোনিবেশ করি। আমার উল্লেখযোগ্য আর্টিকেলের মধ্যে ” সততার সাথে ব্যবসা ও মুনাফা লাভ “ অন্যতম। এ লিখাটি অনলাইনে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। লিখাটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকায় “ ৪৫ লাখ পাঠকের ভালবাসায় মমিন মোল্লা “ নামে বিভিন্ন পত্রিকায় আমার সাক্ষাৎকার ছাপা হয় । “ সাপ্তাহিক আমোদ-এর ৫০ বছর পূর্তি থেকে দেবিদ্বার সংবাদদাতা হিসাবে পরিচয়পত্র লাভ করি। তখন আমাদের গ্রামে সকাল বেলা দৈনিক পত্রিকা পাওয়া যেত না। চান্দিনা অথবা দেবিদ্বারে ব্যবসায়ীরা মালামাল আনতে গেলে সংবাদপত্র হাতে করে নিয়ে আসতেন। ব্যক্তিগতভাবে সাধারণত কেউ পত্রিকা নিয়মিত রাখতেন না। আমি নিজেও দেবিদ্বার সুজাত আলী সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় ক্লাশ শেষে বাড়ি ফেরার পথে পত্রিকা নিয়ে এসে শ্রী অনিল ঠাকুরের দোকানে দিতাম। অনিল চক্রবর্তী মূলত ইত্তেফাক অফিসে কাজ করতেন । লেটার প্রেস উঠে যাওার কারণে অনেকেই অফিস থেকে চলে আসেন। তিনিও তাদের মধ্যে একজন। তিনি একটি মুদি দোকান চালাতেন। মাঝে মাঝে নিউজের ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন, নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেন। তুমি দেবিদ্বারের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ কর সে সংবাদ দেবিদ্বারবাসী যদি দেখতে না পারে তাহলে তোমার নিউজের সার্থকতা কোথায় ? তখন আমোদ সম্পাদক বাকীন রাব্বী ভাই বল্লেন- তুমি যদি পত্রিকা নিতে চাও তাহলে উত্তম হয়। আমি প্রয়োজনে অর্ধেক মূল্য তোমার জন্য ছেড়ে দেব। উল্লেখ্য আমি যেসব পত্রিকায় কাজ করেছি সেগুলোতে কোন প্রকার চাপ ছিল না। কারেন্ট নিউজ সাধ্যমত পাঠাতাম কিন্তু বিজ্ঞাপনে কোন রকম টার্গেট ছিল না। তাই লেখাপড়ার পাশাপশি পত্রিকায় কাজ করতে পেরেছি। এক এক করে গ্রাহক বাড়তে বাড়তে তা একসময় এলাহাবাদ বাজারেই ৪৭ এ পৌঁছে। তাছাড়া দেবিদ্বার-মুরাদনগরে মিলিয়ে তা হয়ে যায় প্রাায় ২০০ জন। পত্রিকা বের হতো বৃহস্পতিবার। এখনও তাই হচ্ছে। শুক্রবার বন্ধ থাকায় পত্রিকা পেতে দেরী হয়ে যেত। তাই শুক্রবারের পরিবর্তে রোববারে পত্রিকা বের হলে আমার জন্য সুবিধা হয়। এ পস্তাব করলে তাতে তিনি রাজী না হয়ে বল্লেন, একটা কাজ আমি তোমার জন্য করতে পারি। তুমি বৃহস্পতিবারে পত্রিকা পেতে চাও ? তাহলে সার্কুলেশনের আলম যদি কষ্ট করে বুধবারে রাতে নৈশ বিভাগ থেকে পোস্ট করতে পারে তাহলে কুমিল্লার পাঠকরা যখন পত্রিকা পাবে তখন এলাহাবাদের পাঠকরাও একই সময়ে পত্রিকা পাবে। তখন থেকে দুইশ’ পত্রিকা আমার রেফারেন্সে পাঠানো হতো । আমাকে কখনও বিজ্ঞাপনের জন্য বলা না হলেও আমি হারিয়েছি, পুড়ে গেছে,স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সহ ৫০ তম বর্ষে দেবিদ্বারের উপজেলা নির্বাহী অফিসার থেকে শুভেচ্ছা বিজ্ঞাপন কালেকশন করেছিলাম ।
নিজেকে মোহমুক্ত রেখে নিজস্ব মূল্যবোধ বজায় রাখার মধ্য দিয়ে কোন ইস্যুকে প্রতিবেদনে তুলে আনার নামই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। আমি সবসময় আমার পেশাগত কাজে এ বিষয়টি খেয়াল রেখেছি। তাই ভিন্ন কোন গতি বা রীতির সাথে কোন সম্পর্ক রাখিনি। আমি চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীনের আদর্শ লালন করি। তার সম্পর্কে কবি শামসুর রহমান লিখেছেন, ‘দিনভর খাটুনি ধকল পোহানো কিশোরীর /খড়ের উপর ঘুম-ইত্যাদি দেখেছি , মেনাজাত/তোমারই সৌজন্যে ; সেই ঋণস্বী কারে অকুণ্ঠ আমি । আমিও চলতি সংবাদের পাশাপাশি গ্রামের আর্থ-সমাজিক,রাজনৈতিক,ইতিহাস,ঐতিহ্য, খেলাধুলা ও কৃষ্টি-কালচারকে লেখার বিষয়বস্তুতে পরিণত করি। আমোদ এ লেখাগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পেছনের পৃষ্ঠায় স্থান দিত।
আমি কুমিল্লার তিনজন সম্পাদককে সাংবাদিক গুরু হিসাবে পেয়েছি। তারা হলেন জনাব আব্দুল ওহাব-দৈনিক রুপসী বাংলা, মোহাম্মদ উল্লাহ-সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ এবং আমোদ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী। ফজলে রাব্বীর একটি কথা এখনও মনে পড়ে,তিনি প্রায় সময় আমাকে বলতেন ”গো এহেড মাই চাইল্ড “। ঢুলির কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয় । সে নিজের আনন্দের জন্য বাজায় না। অন্যকে আনন্দ দানের মাধ্যমে তার কাজের স্বার্থকতা ফুটে উঠে। মূলত আমোদ ছিল সাংবাদিক তৈরির কাখানা। আর ফজলে রাব্বী ছিলেন এর নিরলস কারিগর । মিডিয়া এমন একটি জায়গা যেখানে শিক্ষার পাশাপাশি বিচক্ষণতাকেও কাজে লাগাতে হয়। যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি, জনগণের কণ্ঠস্বর হিসাবে কাজ করেছি।
প্রথম যখন লিখতাম তখন ছাপার অক্ষরে আমার নিজের নাম দেখে খুব ভাল লাগতো। হঠাৎ করে নেশা জাগলো কতটি পত্রিকায় আার্টিকেল লিখে আমার নাম আনা সম্ভব। তা একটু চেষ্ট করে দেখা যাক। প্রথম আলোর সোহাগ ভাই বল্লেন “তুমি পাগল হয়েছো নাকি সবাই লিখে টাকার জন্য আর তুমি ….। ” তবে বাশার ভাই উৎসাহ দিলেন। বল্লেন “আমি এক সময় একাই হাতে লিখে ৫৩ টি পত্রিকায় নিউজ পাঠাতাম। ভাবনা থেকেই কাজের শুরু। আর পেছনে তাকাইনি, দুবছরের মাথায় দেখলাম প্রিন্ট এবং অনলাইন মিলে ১০০ টি পত্রিকা আমার হাতে চলে এসেছে। এ নিয়ে মিডিয়া সহযোগীগণ লিখলেন- ”মমিন মোল্লার অন্যরকম সেঞ্চুরি ।”
সাংবাদিকতা শেখার জন্য ডাকযোগে বই এনে পড়েছি, বিসিডিজেসি-৯০, প্রথম আলো- ২০১০, পিআইবির বেসিক সাংবাদিকতা কোর্স-,বিসিডিজেসির ফিচার বিষয়ক কোর্স, পিআইবির ২য় কোর্স এবং রয়টারের ডিজিটাল সাংবাদিকতা কোর্স করেছি। তবে কাগজে কলমে যে শিক্ষা আমোদ সম্পাদক বাকীন রাব্বী দিয়েছেন, তার কোন তুলনা হয় না। দেবিদ্বারের চরববাকরের মুক্তিযুদ্ধ সহযোগী জব্বার আলী যুদ্ধের সময় রিক্সাযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন যায়গায় নিয়ে যেতেন। তখন তিনি ছিলেন তারুণ্যেউদ্দীপ্ত যুবক। তাকে সবাই জব্বার একপ্রেস বলে ডাকতেন। কিন্তু ৯০ এর দশকের শেষভাগে তার বয়স যখন ৭০ তখন তার রিক্সায় কেউ উঠেনা । আমি তখন একটি বোঝাই রিক্সায় জব্বার আলীকে উঠিয়ে ছবি তুলে পত্রিকায় পাঠালে বাকীন ভাই বল্লেন,’ বর্তমানে দশ বছরের বাচ্চাও ছবি উঠাতে পারে। টিপ দিলাম আর ছবি উঠলো, এটাতো কোন পত্রিকার ছবি হতে পারে না। পত্রিকার একটি ছবি হাজার শব্দ থেকেও শক্তিশালী।” তখন জানতে পারলাম বাকীন ভাই ফটোগ্রাফির উপর বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কুমিল্লা এবং ঢাকায় একক চিত্র প্রদর্শনী করে সুনাম অর্জন করেছেন। তখন থেকে ছবি তোলায় বিশেষ মনযোগী হলাম। পরিশেষে আমোদ প্রকাশনার সাথে জড়িত সবাইকে এবং সম্মানিত পাঠকদের আশির্বাদ কামনা করছি।

লেখক: কলামিস্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক,কুমিল্লা। ০১৭১১-৭১৩২৫৭।